সভ্যতার সংকট, বাঙালির দুঃসময় :
৩৬৫ দিন। ১৭৫৭ সালের অবিভক্ত বাংলা। গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের জেরে কিছু অংশ শুদ্র বৌদ্ধ হয়ে গেছেন, কিছু মুসলমান । কিন্তু বৃহত্তর সুশাসনের ফলে বাংলার মানুষ দুধে ভাতেই আছে। কৃষকের গোলা ভরা ধান, ধান ক্ষেতের সবুজ ধান সোনালী রং ধরার প্রতীক্ষায় । সব ধর্মের মানুষ শান্তির সঙ্গে বসবাস করেন। ও পাড়ায় পরব হলে এ পাড়ায় ডাক পড়ে। এপাড়ায় মজলিশে ও পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়। সোনা ঝরা রাজ্যে আগুন ঝরা মানুষ, যারা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণপাত লড়াই করেছেন, ইতিহাস যার সাক্ষী। তখনো বাংলায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়নি। কাজেই কৃষকের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। আরো কিছু পরে অন্যত্র শস্য মজুত করে কৃষককে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলে দেওয়ার গল্প আসতে অনেক দেরি, সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের, যেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ মারা গিয়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন ৮৫ লক্ষ বাঙালি মানুষ। সেইসব পুরোনো ইতিহাস, যে ইতিহাসে গ্রথিত আছে কিভাবে শস্য শ্যামলা বর্ধিষ্ণু বাংলাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কাঙাল করে দিয়েছিল। যে কৃষক পরিবার মোগল আমলের বাংলায় দুধে ভাতে থাকত, সেই কৃষক পরিবারেরা দলে দলে কলকাতার রাস্তায় ভিক্ষা করে বলতেন ‘ফ্যান দে।’ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় তখন বাঙালির লাশ, গ্রাম বাংলার বাঙালির, গ্রাম বাংলায় কৃষকের, যারা ব্রিটিশ সরকারের দুঃশাসনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত, সর্বহারা। যদিও উইন্সস্টন চার্চিলের কুখ্যাত উক্তি আছে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল কারণ, বাংলার জনসংখ্যা ইঁদুরের মতো বেড়ে যাচ্ছিল তাই। আসলে তা যে রাষ্ট্র সন্ত্রাস ছিল ও আসলে তা বাঙালির কোমর ভেঙে দেওয়ার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র, তা পরবর্তী কালের ঐতিহাসিকরা প্রমাণিত করে দিয়েছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলেন নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন। এতো গেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ইংরেজদের শাসন কালের কথা। কিন্তু এই ইংরেজরা বাংলায় ঢুকল কি করে, কে ঢুকতে দিল এই বাংলা তথা ভারত বিরোধী বর্গীদের? এই ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে পলাশীর যুদ্ধে, সেই আমবাগান, ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল যেদিন বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও রায়দুর্লভের চক্রান্তে সিরাজদৌল্লার বিশাল সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে।
মাত্র ২৪ বছর বয়সী নবাবকে প্রাণ দিতে হয় সেই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব। যেদিন নবাব সিরাজদৌল্লার মৃত্যুর ঘটল, তারপর তার বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীরজাফরকে ব্রিটিশ সরকার নবাবের মসনদে বসায়। নবাব শুধু নামেই। ইংরেজদের হাতের পুতুল ছিলেন তিনি। তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলতেন। কারণ সেটাই ছিল তার নবাব হওয়ার শর্ত। সেই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আজও মীরজাফরের বাড়ির নাম ‘নেমক হারাম দেউটি। পর্যটকরা আজও সেই দেউটির সামনে গিয়ে ঢিল ছুড়ে আসেন। আজও বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের বংশধররা তাদের বংশপরিচয় লুকিয়ে রাখে। তারপর বাংলায় কালো অন্ধকার নেমে এলো। সেই অন্ধকার নামিয়ে আনলেন যারা – মীরজাফর, জগৎ শেঠ, ঘসেটা বেগম, এবং তাদের সাহায্য করেছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। এরা সবাই বাংলাকে ভালোবেসে নয়, নিজের নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে অন্ধ হয়ে বিদেশী শাসকের রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। এই ইতিহাস সবাই জানে ৷ তাও আজকের দিনে আর একবার ঝালিয়ে নেবার দরকার আছে বৈকি। দরকার এই জন্যে যে এই ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা হচ্ছে আর একবার ব্যক্তিগত স্বার্থে। দুয়ারে নির্বাচন, আর সেই নির্বাচনে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুত্রবধূ অমৃতা রায়। তার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনে তিনি বলেছেন যে, তার পূর্বপুরুষ নাকি সিরাজদৌল্লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও ইংরেজদের সাহায্য করে ঠিক কাজ করেছিলেন। কারণ এমনটি না করলে ভারতবর্ষে তথা বাংলায় একটিও হিন্দু থাকত না। সবাই ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হতে বাধ্য হত। কি আশ্চর্য কথা। সাম্প্রদায়িক তো বটেই, একথা সর্বৈব অসত্য ও উস্কানিমূলক। ব্রিটিশরা আসার আগে মোগলরা ভারতবর্ষে পাঁচশো বছর রাজত্ব করে গেছে। এই যুক্তিতে তো ৫০০ বছরে ভারতবর্ষে আর কোন হিন্দু অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। অথচ ভারতে স্বাধীনতার সময়, অবিভক্ত অবস্থাতেও, মুসলমানের সংখ্যা কখনো ২০ এর ওপর ছিল না। আর বিভাজনের পর ছিল সাত শতাংশ। এমন উক্তি বিপজ্জনক ও বিশেষভাবে প্ররোচনামূলক। ঠিক যেভাবে গডসেকে ভগবান বানানোর চেষ্টা করে চলেছে রাজনৈতিক একটি দল, এবং গান্ধীকে ভিলেন, ঠিক সেইরকম সিরাজদৌল্লাকে ভিলেন বানিয়ে মীরজাফর, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে নায়ক বানানোর চেষ্টা। ইতিহাসকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিবর্তন করা এই প্রথম নিদর্শন নয়। ইদানীংকালে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে মোগল জমানাকে।
ভারতবর্ষের একমাত্র নায়ক রাজারা নাকি ছিলেন হিন্দু রাজারা। সেই ইতিহাসকে আরো ভালোভাবে সুষ্ঠুভাবে বিকৃত করার জন্যই কি তবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই প্রার্থীকে? বাংলা তথা ভারতবর্ষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল যে রাজ পরিবার, বিদেশি শক্তিকে যারা বাংলার মাটি দখল করতে সাহায্য করেছিল, সেই পরিবারের পুত্রবধূকে বেছে নেওয়ার আর কি কারণ থাকতে পারে? বাংলার মানুষ নিশ্চয়ই ইতিহাস বিস্মৃত হবেন না। বাঙালি শিক্ষিত, গর্বিত বীরদের ও বীরাঙ্গনাদের জাতি। তারা রক্ত ঝরিয়ে ব্রিটিশদের বিদায় করেছিল এই বাংলা থেকে। সেই রক্ত ঝরানো বিপ্লবের অপমান তারা হতে দেবে না। তারা জানে কারা সত্যিকারের দেশপ্রেমী আর কারা ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বিদেশি শক্তির কাছে বাংলাকে বিক্রি করেছিল।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর কথায় ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি চিনে নিক দুর্বৃত্ত’।