পতঞ্জলির ১৪ পণ্যের লাইসেন্স বাতিল
৩৬৫ দিন। সময়টা ভালো যাচ্ছেনা যোগগুরু রামদেবের। প্রিয় শীর্ষাসনেও নাকি তিনি এনার্জি পাচ্ছেন না। একদিকে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে গোমূত্র, গোবরের বিস্কুট কিংবা ঘাসপাতার কেশতেল, গাছের ছালের দাঁতের মাজন, তার ওপরে আবার ১৪ টি পণ্যের লাইসেন্স বাতিলের নোটিশ। একের পর এক ধাক্কা। সুপ্রিম কোর্টের কাছে কানমলা খেয়ে, করজোড়ে ক্ষমা চেয়েও হচ্ছে না। এবার নিজভূমে অর্থাৎ উত্তরাখণ্ডের প্রশাসন পতঞ্জলির ১৪ টি পণ্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, সেগুলোর লাইসেন্স বাতিল করল। একই সঙ্গে রামদেব ও তার সহযোগী বালকৃষ্ণর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করল উত্তরাখণ্ড সরকার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ১৫ এপ্রিল রাজ্যের লাইসেন্সিং অথরিটি পতঞ্জলির ১৪টি পণ্য উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে হরিদ্বারের আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি আধিকারিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছেন যোগগুরু রামদেব ও তাঁর সহকারী আচার্য বালকৃষ্ণর বিরুদ্ধে। পতঞ্জলির বিরুদ্ধেও আলাদাভাবে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কদিন আগেই বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের মামলায় সম্প্রতি প্রবল অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে রামদেব ও তাঁর সংস্থাকে। বার বার সুপ্রিম কোর্ট ভর্ৎসনা করেছে তাঁদের। গত মঙ্গলবার সংবাদপত্রে ক্ষমা চায় পতঞ্জলি। কিন্তু শীর্ষ আদালতের তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, রামদেবের ক্ষমাপ্রার্থনা নাকচ করা হল। কারণ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমা মোটেও আন্তরিক ছিল না। পরের দিন আবারও সুপ্রিম কোর্টের কাছে ক্ষমা চান রামদেব। বিশ্বের অন্য কোনোও রাষ্ট্র হলে মিথ্যে অসুখ সরানোর নামে রামদেব ও তার সংস্থার এই ভেজাল ওষুধ বিক্রির শাস্তি হত মৃত্যুদণ্ড। এবার আদালতের বাইরেও অস্বস্তিতে পড়তে হল যোগগুরুকে। কিন্তু তিন বছর আগে পর্যন্ত যিনি মোদির ব্লু আইড যোগগুরু ছিলেন, তার এই উল্কার মত পতন কেন? রীতিমত রামদেবকে রোল মডেল বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ২০১৯ সালে স্বয়ং অমিত শাহ তাকে নিয়ে নিয়ে রাজনীতিক মিটিং করেছেন। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ভাজপা রমদেবকে জয়প্রকাশ নারায়ণের মত মানুষের নেতা বলে উল্লেখ করে। ক্ষমতায় আসার পর উত্তরাখণ্ড এ সনাতন ভারতীয় ঔষধি নির্মাণে রামদেবকে বিনামূল্যে ২০০০ একর জমি দেয় বিজেপি সরকার। ২০১৯ নির্বাচনেও রামদেবের লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর সাপোর্ট চেয়েছেন, মোদি, শাহ, পেয়েছেন। জেড প্লাস ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়া হয় তাকে। আজ সেই রামদেব কানমলা খাচ্ছেন। কেন?
রামদেবকে প্রমোট করে ভাজপা
এতদিন মোদি, অমিত শাহরা পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছেন রামদেব এবং তাঁর ভন্ডামিকে। মিথ্যে হিন্দুত্বের হওয়া দেশজুড়ে তুলে রাখতে রামদেব ছিল অন্যতম হাতিয়ার। বিশ্ব যোগ দিবসের পরিকল্পনা তারই মস্তিষ্কপ্রসূত।
দেশের প্রতিটি কোণে টেলিভিশনে ভোর থেকে রাত রামদেবের প্রমোশন, গ্রামে গঞ্জে পতঞ্জলির আউটলেট, টেলিভিশনের বিখ্যাত সব রিয়েলিটি শোতে হেটমুন্ড ঊর্ধপদ সার্কাস, সেলিব্রেটিদের হামলে পড়ে সেলফি, এ সবই হিন্দুত্বের হওয়া তোলার পরিকল্পনার অংশ। সেটা বাড়তে বাড়তে এই জায়গায় পৌঁছে যায় যে, সরাসরি রামদেব দেশের ন্যাশনাল ডক্টরস মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। বিজ্ঞান নাকি বিশ্বাস?
এই জায়গায় চলে যায় যুদ্ধ। মহামারীর প্রথম ঢেউ পর্যন্ত মোদি নিজে থালা বাজিয়ে, ভাজপা নেতৃত্ব গোমূত্র খাইয়ে কো ভাইরাসকে রোখার প্ল্যান করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ সব উল্টে দেয় হিসেব। মহামানব রামদেব নিজে কোভিডে কাবু হয়ে পড়েন। ততদিনে মোদি, অমিত শাহরা রামদেবের থেকে সরে গিয়েছেন। যে রামদেবকে প্রমোট করে ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশে সনাতন চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ, ভেষজ এর রমরমা ঘটিয়ে একটা হিন্দু জাগরণ ঘটিয়েছিল ভাজপা, সেই রামদেবকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ভাজপা। কিন্তু কেন? মনোহরের দিয়ে যাওয়া তথ্য অনুযায়ী অংকটা জটিল।
রামদেব ভাজপা সম্পর্কে চিড়
সেই ২০২০ সালে পিএম রিলিফ ফান্ড এ অর্থ না দিতে চাওয়ার পর থেকেই কি রামদেবের এই রাহুর দশার শুরু? নাকি আরও অন্য কোনও রহস্য? উত্তরাখণ্ডের একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক মনোহর রই বছর দুই আগে রামদেব এবং কেন্দ্রীয় ভাজপার মধ্যে দূরত্ব না মনোমালিন্যের কারণ তুলে ধরেন। ফলে তাকে চাকরি হারাতে হয়। কিন্তু মনোহরের যুক্তি এবং বিশ্লেষণকে এখন মেনে নিচ্ছে রাজনীতিক মহল। মনোহর সেই প্রতিবাদী মানুষ যিনি উত্তরাখণ্ডের পাহাড়, জঙ্গল এবং ন্যাচারাল রিসোর্স সমৃদ্ধ বিপুল জমি বিনে পয়সায় রামদেবকে ব্যবসা করার জন্য প্রতিবাদ করেছিলেন। মনোহর তার চাকরি খুয়েইছেন, কাগজ উঠে গিয়েছে, তিনিও মহামারীতে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত কোভিড রুখতে রামদেবের গোমূত্র ওষুধ কাউকে খেতে দেননি।
ক) রামদেবের ইচ্ছে ছিল জাতীয় রাজনীতিতে আসার। কিন্তু সেটা কোনও কারণে গৃহীত হয়নি। গেরুয়া পোশাক পরা, এই যোগগুরুকে একবার অনেকের থেকে বেশি হিন্দু দেখালে মুশকিল। তখন আরেকজনকে বিশ্বগুরু করে তোলার কাজ চলছে কূটনৈতিক মহলে। ফলে রামদেবের প্রথম ধাক্কা ২০১৯ সালেই।
খ) পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ বেশি মাইলেজ পেতেই ফুঁসে ওঠে ওষুধ সংস্থারা। কারণ তারা ইতিমধ্যেই বিপুল টাকার বন্ড কিনে ফেলে ভাজপার পকেটে টাকা ঢুকিয়েছে।
গ) করোনার সময় যখন বিপুল টাকা দিয়ে দেশে ভ্যাকসিন কেনা হচ্ছে তখন রামদেব পাল্টা কোভিড নাশক বড়ি নিয়ে এল। চাপ বাড়ল ভাজপার। ঘ) পতঞ্জলির ৮৭ টি কনজিউমার ও ফুড প্রোডাক্টস এর সঙ্গে আদানির প্রোডাক্ট এর টক্কর হচ্ছিল। এর মধ্যেই ফরচুন ব্র্যান্ড কিনে নেয় আদানি। যেটা নিয়ে বিড করেছিল আদানিও। কিন্তু রামদেবের সংস্থার হাতছাড়া হয় ব্র্যান্ড। প্রোডাক্টের মার্কেট শেয়ার নিয়ে জোর টক্কর, আদনির পাশে কেন্দ্রের ভাজপা দাঁড়ায়, রামদেব সাইড হয়ে যায়।