দেশের প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ৮০০০ অযোগ্যের জন্য ২৬০০০ চাকরি বাতিল হতে পারে না
৩৬৫ দিন। নয়াদিল্লি। এসএসসি নিয়োেগ দুর্নীতি মামলায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের যে নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ পেয়েছিল তার উপরে স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিল ১৬ই জুলাই পরবর্তী শুনানির আগে পর্যন্ত কারুর চাকরি যাবে না। তবে যেহেতু এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই তদন্ত এখনো সম্পূর্ণ হয়নি তাই দুর্নীতি খোঁজার জন্য সিবিআই এর তদন্ত চলবে। যদিও পরবর্তী শুনানির আগে পর্যন্ত সিবিআই কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না বলেও নির্দেশ দিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের রায় দেওয়ার পরেই মমতা প্রকাশ্য জনসভা থেকে ঘোষণা করেছিলেন যতদূর যেতে হয় রাজ্য সরকার যাবে আইনে লড়াইয়ের জন্য।
যোগ্য অযোগ্য বাছাই সম্ভব হলে ২৬০০০ ছাঁটাই কেন
এর আগের দিনের শুনানিতে রাজ্য সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবী স্পষ্টভাবে সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ সমস্ত পক্ষের কথা না শুনে একতরফা রায় দিয়ে ছাব্বিশ হাজার চাকরি ছাটাই এর নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি রাজ্য সরকার এবং এসএসসি সুপ্রিম কোর্টের জানিয়েছিল কিভাবে যোগ্য এবং অযোগ্যদের পার্থক্য করা সম্ভব। পাশাপাশি এসএসসির আইনজীবী কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের বাস্তব ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, মাথা ব্যথা হলে, মাথা কেটে বাদ দেওয়া যায় না।
আজ বিস্তারিতভাবে বিষয়টি জানার পরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রীতিমতো প্রশ্ন তুলে দেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির রায়ের উপরে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, সিবিআই তদন্তেই দেখা গিয়েছে অযোগ্য চাকরি প্রাপক প্রায় ৮ হাজারের কাছাকাছি। তাহলে প্রায় ২৬ হাজার চাকরি ছাটাই এর মত সিদ্ধান্ত কেন নিতে হলো কলকাতা হাইকোর্টকে? এখনো পর্যন্ত তো সিবিআই তদন্ত সম্পূর্ণ হয়নি। সমস্ত পক্ষের নবক্তব্য শোনা উচিত। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ যেভাবে সমস্ত – পক্ষের বক্তব্য না শুনেই ২০১৬ সালের কোটা প্যানেল বাতিল করে ২৬ – হাজার চাকরি ছাটাই এর নির্দেশ দিয়েছিল তা একেবারেই কাম্য নয়। সুপ্রিম – কোর্ট এ দিন নির্দেশ দিতে গিয়ে জানিয়েছে, এসএসসি যদি যোগ্য – অযোগ্যদের বিভাজন করতে পারে, তাহলে গোটা প্যানেল বাতিল ন্যায্য নয়।
চাকরি ছাঁটাই এর পক্ষে সওয়াল বিকাশের
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি একসঙ্গে ২৬ হাজার চাকরিপ্রাপকের চাকরি ছাটাই এর সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত নয় বলে স্থগিতাদেশ দিলেও এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেন সিপিএমের রাজ্যসভা সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। বিকাশ বারে বারে সুপ্রিম কোর্টে দাবি করেন ২০১৬ সালের গোটা প্যানেল বাতিল করে ২৬ হাজার চাকরি ছাটাই এর সিদ্ধান্তকে সুপ্রিমকোর্ট যেন সমর্থন করে। কারণ সুপ্রিম কোর্ট চাকরি ছাটাই এর উপর স্থগিতাদেশ দিলে বাংলার ভোটে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক অভিঘাত হবে ভীষণভাবে।
তবে মামলা বিকাশের এমন রাজনৈতিক বক্তব্য খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোকনা কেন, এখানে আমরা সবাই বিচার ব্যবস্থার অঙ্গ। ফলে আমাদের সেই শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। শান্তিপূর্ণ ভাবে শুনানি সম্ভব হচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশ
দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় আজ অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিতে গিয়ে জানান আগামী ১৬ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে। বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষা কর্মী যেভাবে কাজ করছিলেন তারা নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে পরে যদি প্রমাণিত হয় কেউ দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন তাদেরকে বেতনের টাকা ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের ডিভিশন বেঞ্চ অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বিরুদ্ধে এবং রাজ্য মন্ত্রিসভা কিভাবে অতিরিক্ত পদ তৈরি করল সেই বিষয় সিবিআইকে তদন্তের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই নির্দেশ বহাল রেখে সুপ্রিমকোর্ট জানিয়ে দেয় সেবিআই তদন্ত চলবে কিন্তু কারো বিরুদ্ধে কোন আইনি পদক্ষেপ করতে পারবে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। প্রসঙ্গত, ২০১৬ এসএসসি দূর্নীতি মামলার জেরে চাকরি গিয়েছিল প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের। সেই নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের পর সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল মামলা। সেখানে রাজ্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও এসএসসির তরফ থেকে আবেদন করা হয়। এসএসসি মামলার শুনানি শুরু সুপ্রিম কোর্টে। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে বাতিল হয়েছে ২০১৬ সালের গোটা প্যানেল। যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে চাকরিহারা ২৫,৭৫৩ জন। তাঁদের ভাগ্য ঝুলছে সুপ্রিম কোর্টে। এদিন শুনানি শুরু হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রাজ্যের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, ২০২২ সালে কেন সুপারনিউমেরিক পোস্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য? জবাবে রাজ্যের আইনজীবী জানান, প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আড়াই বছর পরে ২০২১ সালে মামলা দায়ের করা হয়। এসএসসি-তে বেআইনি নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কেন আপনারা সুপারনিউমেরিক পদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন? ফের জানতে চান বিচারপতি। তাঁর প্রশ্ন, ২০১৬ সালে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০১৯ সালে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়। ২০২১ সালে মামলা। তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন ৬ বছর পরে কোনও ওয়েট লিস্টেড প্রার্থী বেআইনি অভিযোগ তুলে চাকরি চাইতে পারবেন না? প্রধান বিচারপতির প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের আইনজীবী বলেন, সুপারনিউমেরিক পদ তৈরির পিছনে রাজ্যের কোনও খারাপ অভিসন্ধি ছিল না। বেআইনি নিয়োগ ঢাকতে এই পদ তৈরি করতে হয়নি। চাকরি বাতিলের ফলে ওয়েটিংলিস্ট থেকে নিয়োগ করার জন্যই সুপারনিউমেরিক পোস্ট তৈরির সিদ্ধান্ত। নতুন করে ৬৮৬১ পদ তৈরি করা হয়েছিল। রাজ্যের দাবি, আদালতকে বোকা বানানোর জন্য সুপারনিউমেরিক পদ আনা হয়নি। রাজ্যের উদ্দেশ্য ছিল, চাকরি বাতিলের পর শূন্যপদে ওয়েটিং লিস্ট থেকে নিয়োগ করতে। বেআইনি নিয়োগ আড়াল করার কোনও মতলব ছিল না। বেআইনি নিয়োগকে সুপারনিউমেরিক পদের জন্যে যুক্ত করা হয়নি।