বাংলা হল শক্তিভূমি
উপসনা থেকে সংস্কৃতি মাছ,মাংস ছাড়া অস্তিত্বই বিপন্ন
জন্মলগ্ন থেকে বিজেপি বাঙালি-বিদ্বেষী, বাংলা-বিদ্বেষী। ভারতের যতোগুলো প্রধান রাজনৈতিক দল আছে, তাদের চেয়ে বিজেপি সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ, সব দল মানুষের কাছে ভোট চায়। বিজেপির পিছনে আছে আরএসএস নামক একটি ভারতীয় নাজিবাদী ফ্যাসিস্ত সংগঠন। তাই বিজেপি কেবল ভোট চায় না। বিজেপি মানুষের মগজ দখল করতে চায়। এবং সেই দখলীকৃত মগজের সাহায্যে নিজেদের ইচ্ছেমতো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চায় তারা। উত্তর ভারতের গো-বলয়ের আদ্যন্ত পশ্চাৎপদ সঙ্কীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি তারা চাপিয়ে দিতে চায় দেশের বহুধাবিচিত্র সাংস্কৃতিক, ভাষিক, আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর উপরে। পূর্বভারতের সংস্কৃতি ইতিহাসগতভাবেই উত্তর ভারতের গোরুপূজক সংস্কৃতি থেকে আলাদা। বাঙালি মূলত শাক্ত, মাতৃকাসাধক, তন্ত্রে বিশ্বাসী অথবা শৈব। বৈষ্ণব এবং অন্য কয়েকটি সেক্ট বাদ দিলে বাঙালি মূলত মাছ-মাংসভোজী, আমিশাষী। বৈষ্ণব পরিবারেও লাউ বা কুমড়ো বলি দেওয়া হত পশুবলির রিচুয়াল মেনে। আর, বাঙালির শাক্তসাধনায় মাংস ও মদ অনিবার্য।
কালী বেদপূর্ব। তিনি উপমহাদেশে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে পূজিত। সুকুমার সেন লিখেছেন, ঊষা এবং নিশার উপাসনা প্রাচীন কাল থেকে প্ৰচলিত ছিল। হরপ্পা সভ্যতার ঊষা ও নিশা থেকে আজকের দুর্গা ও কালী এসেছেন। ঋগ্বেদে রাত্রিসূক্তে এই নিশার ছায়া আছে।বাঙালি জাতির সবথেকে প্রাচীন প্রত্ন স্থল পাণ্ডু রাজার ঢিবি। চার সহস্র বছর পুরোনো। সেই সভ্যতা ছিল মাতৃকা উপাসক। শক্তির উপাসনা মানেই মৎস এবং পল (মাংস)।’বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব’ শীর্ষক মহাগ্রন্থে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন যে বাঙালি জাতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত, এবং সে কারণে প্রাচীনকাল থেকেই চিন, জাপান, ব্রহ্মদেশ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী বঙ্গদেশেও মাছ মাংস খাওয়ার প্রচলন আছে। বঙ্গদেশে মুসলমান শাসনের অনেক আগে থেকেই এখানে আমিষ ভক্ষণের ঐতিহ্য আছে। সুতরাং মোদি যে বলছেন আমিষ খাওয়া মোগল মানসিকতা, তিনি বোধহয় সবটা জেনে বলেন নি। এমনকী দুর্গাপুজো বা অন্যান্য উৎসবেও বাঙালিরা আমিষ খায়। বাঙালিকে এই খাদ্যাভ্যাস পালটাতে বলার স্পর্ধা কেউই আজ অব্দি দেখায়নি।
কারণ, বাঙালির এই বিশেষ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বিজেপির কোনও পরিচয় বা একাত্মতা নেই। তারা মূলত ফ্যাসিবাদী কায়দায় অন্য জনগোষ্ঠীর উপরে নিজেদের সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাস চাপিয়ে দিতে চায়। সেই বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার একটি কদর্য নিদর্শন কাশ্মীরের নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ, যেখানে তিনি বলেছেন, যারা রামনবমীতে মাছ-মাংস খায়, তারা হিন্দু নয়। তারা দেশদ্রোহী। এটি কোনও আলটপকা মন্তব্য নয়। এটির পিছনে আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র নির্মাণের যাবতীয় নীল নকশার সারবস্তুটুকু লুকিয়ে আছে। এমনিতেই বিজেপি নেতারা হুমকি দিচ্ছেন, তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে দেশের সংবিধান বদলে দেবেন। বাকস্বাধীনতা, যা সংবিধানের আর্টিকল ১৯-এর একটি প্রধান অধিকার সেটি ছিনিয়ে নেবেন তাঁরা। ফলত মোদিজির এই ভাষণ বাঙালির কাছে আজ একটি থ্রেট।
বাঙালিকে আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি নিজেদের জাতিগত অস্মিতা বজায় রাখবে, নাকি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের আধিপত্যবাদী গেরুয়া সংস্কৃতি মেনে নেবে? আমরা কি আমাদের প্রিয় বাংলার গেরুয়াকরণ মেনে নেব, নাকি সোচ্চারে, সজোরে বলব: গেরুয়া আধিপত্যবাদী বিজেপি বাংলা থেকে দূর হটো। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদ মানছি না, মানব না। আসুন, আমরা সমবেতভাবে এই ফ্যাসিস্ত ফতোয়া অগ্রাহ্য করি। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের উপর কারো অনৈতিক হস্তক্ষেপ আমরা মানছি না। মানব না।
ড. অর্ণব সাহা। অধ্যাপক।