সৌগত মন্ডল। খবর ৩৬৫ দিন।
এভাবেও ফিরে আসা যায়! সুন্দরবনের জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মরিচঝাঁপি সংলগ্ন কালিদাসপুর গ্রামের জগদীশকে উদ্ধার করে এনেছিলেন ২ সঙ্গী মৎস্যজীবী। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা পর্যন্ত আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন বাঘের থাবা এবং কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া জগদীশের শরীর দেখে। তিনি বেঁচে উঠবেন এমন আশা করেননি তার স্ত্রী সন্তানেরাও। কিন্তু মিরাকেল এখনো ঘটে! দীর্ঘ প্রায় ১৯ দিনের লড়াইয়ের শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পথে সুন্দরবনের মৎস্যজীবী জগদীশ মন্ডল।
জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। আজন্ম এই দুই মূর্তিমান আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়েই দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সুন্দরবনের মানুষের। তারমধ্যে জীবিকার সন্ধানে দীর্ঘকাল ধরেই ভিন জেলায় অথবা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয় সুন্দরবনের মানুষকে। কিন্তু করো না সংক্রমণ আসার পরে যখন গোটা দেশে লকডাউন হয়ে যায় সেই সময় থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দরবনে বেড়ে গিয়েছে মৎস্যজীবীদের যাতায়াত আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাঘে মানুষের লড়াইয়ের ঘটনা। তবে লড়াই না বলে একতরফা বাঘের আক্রমণ বলাই শ্রেয়।
কারণ সরকারি এবং বেসরকারি পরিসংখ্যান মিলিয়ে দুই ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে এখনো পর্যন্ত গত প্রায় তিন বছরে শুধুমাত্র সুন্দরবনের জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাদ্য হতে হয়েছে অন্তত ১১৮ জন মৎস্যজীবীকে। কিন্তু ব্যতিক্রম তো সবসময়ই থাকে। তেমনি ব্যতিক্রমী নজির তৈরি করেছেন মরিচঝাঁপি সংলগ্ন ছোট মোল্লাখালীর কালিদাসপুর গ্রামের বাসিন্দা জগদীশ মন্ডল।
কি ঘটেছিল
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে চাল ডাল সবজি আর স্টোভ নিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে জগদীশ মন্ডল এবং তার দুই সঙ্গী রওনা দিয়েছিলেন সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। বিপুলসংখ্যক বাঘের বিচরণভূমি বলে পরিচিত চামটার জঙ্গল সংলগ্ন হাঁড়িতে নৌকা দাঁড় করিয়ে কাঁকড়া ধরার দোন ফেলছিলেন নদীতে। দুই সঙ্গী ছিলেন নৌকার দুই মাথায় এবং তিনি ঠিক মাঝখানে। সেই সময়ে আচমকাই খারির পাশের ঘন জঙ্গল থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে টার্গেট করে নৌকায় লাফিয়ে পড়ে মূর্তিমান আতঙ্ক। জগদীশের ডান কানের পাশে থাবা মেরে কাঁধে কামড়ে ধরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবে ক্ষিপ্রতায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিকারী সুন্দরবনের আতঙ্ক রয়েল বেঙ্গল টাইগার কাঁধে কামড়ে ধরেই নৌকা থেকে পরের ঝাঁপ দেয় খাঁড়ির জলে।
এরপর তাঁকে টানতে-টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বাঘটি। কিন্তু জঙ্গলের মাটিতে পা দিতে পারলেই আর কোন সুযোগ নেই বুঝতে পেরে অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে জগদীশের সঙ্গে থাকা দুই মৎস্যজীবী নৌকার বৈঠা এবং দাঁড় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঘের মুখ থেকে জগদীশকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। নিজেদের স্নায়ু ঠিক রেখে সঙ্গীর জন্য এক অসমসাহসী লড়াই লড়েন জগদীশের বাকি দুই সঙ্গী। তাঁরা জগদীশকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাঘের সঙ্গে জগদীশের ওই দুই সঙ্গীর লড়াই চলে। এরপর বাঘ বেগতিক দেখে জগদীশকে ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে যায়। প্রসঙ্গত একটা বাঘের গড় ওজন ১৬০-২২০ কেজি, আর মানুষের গড় ওজন ৭০।
এরপরে অবশ্য রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত জগদীশকে তড়িঘড়ি চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসার বিষয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তার সঙ্গীরা। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে চলে আসেন গোসাবায়। সেখানকার হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসায় সেই ভাবে উন্নতি না হওয়ায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জগদীশকে নিয়ে এসে তারা ভর্তি করেন সোনারপুর সংলগ্ন কালিকাপুর নার্সিংহোমে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া স্বাস্থ্য সাথী কার্ড এর সাহায্যে শুরু করেন চিকিৎসা। বিশিষ্ট চিকিৎসক শুভায়ন বণিকের তত্ত্বাবধানে গত 18 ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার চিকিৎসার পরে এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। তাই মিরাকেল যে এখনো ঘটে, তার প্রমাণ মিলল আরো একবার। কারণ গত সপ্তাহেই সুন্দরবনের ঝড়খালি কোস্টাল থানার এক মৎস্যজীবী ঠিক এভাবেই বাঘের শিকার হওয়ার পরে তার সঙ্গীরা কোনভাবে ক্ষতবিক্ষত দেহটা ফিরিয়ে এনে গোসাবায় নিয়ে আসলেও বেঁচে ঘরে ফিরতে পারেননি তিনি।
ট্রমা কাটাতে বিশেষ চিকিৎসা
সোনারপুর সংলগ্ন কালিকাপুর নার্সিংহোমের বেডে বসে প্রায় সুস্থ জগদীশ বলেন, বাঘ যখন আক্রমণ করেছিল, তখন আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো আর বাঁচব না। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য এখনও আমি ভুলতে পারিনি। শুধু বাঘের ভয় হয়। যদি আবার আমাকে ধরে ফেলে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার পিঠে থাবা মেরে ঘাড় কামড়ে জঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছে এই ছবিটা যেন কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না জগদীশ। তার এই মানসিক ট্রমা কাটানোর জন্য বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্ট কালিকাপুর নার্সিংহোমের কর্ণধার পার্থপ্রিয়া হেমপ্রকাশ। তিনি বলেন “ওর চোখে মুখে এখনো একটা আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে বাঘের আক্রমণের পর থেকে। আমাদের মেডিকেল টিম বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে বিশেষ ধরনের কাউন্সেলিং করে বাঘের আক্রমণের এই ট্রমা থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য।”