ডবল ইঞ্জিন যোগীরাজ্যে পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ
অবিশ্বাস্য অব্যবস্থা মহাকুম্ভে পদপিষ্ট ৩০

হতাহত আরও কয়েক গুণ বাড়ার আশঙ্কা গোলাপ বৃষ্টির জন্য কপ্টার কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নেই

৩৬৫ দিনপ্রয়াগরাজ মহাকুম্ভে শাহি স্নান। তাও আবার ১৪৪ বছর পরে। আর সেই শাহি স্নানের দিনেই চরম অব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক গাফিলতিতে পদপিষ্ট হয়ে শাহি স্নানের আগেই থ্যাঁতলানো দলা পাকানো মাংসপিণ্ডে পরিণত হল অন্তত ৩০ তীর্থযাত্রীর দেহ। মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও উত্তরপ্রদেশ সরকার ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে ঘটনাস্থলে সংবাদমাধ্যমের ঢোকা বন্ধ করে দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা চাপতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

জাতীয় মেলার স্বীকৃতি পাওয়া কুম্ভ মেলায় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা এবং তাদের সুযোগ সুবিধা দেখভালের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা হয়েছিল বিপুল অংকের কোটি কোটি টাকা। আজ শাহী স্নানের পুণ্য তিথিতে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রাণ থেকে তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ১০ কোটি পুন্নার্থে শাহি স্নান করবেন বলে দাবি করে ২৫ কুইন্টাল গোলাপের পাপড়ি হেলিকপ্টার থেকে পুণ্যার্থীদের মাথার উপরে পুষ্প বৃষ্টি করবে বলে উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার দুটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রেখেছিল গেরুয়া রং করে। যতই হোক ভাজপার ডাবল ইঞ্জিন রাজ্য বলে কথা! তবে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানোর জন্য হেলিকপ্টার প্রস্তুত থাকলেও পদপিষ্ট হয়ে যখন পুণ্যার্থীরা একটু চিকিৎসার জন্য হাহাকার করছে তাদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মিললো না এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা। যদিও চলতি মাসেই বাংলায় গঙ্গাসাগর মেলার সময় সম্পূর্ণ নদী এবং সমুদ্র দিয়ে ঘেরা সাগরদ্বীপ থেকে অন্তত ১০ গুরুতর অসুস্থ পুণ্যার্থীদের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়িয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল বাংলায় মমতার সরকার।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল দুর্ঘটনা ঘটার পর আহতদের উদ্ধারে যেমন যোগী সরকার বিন্দুমাত্র তৎপরতা দেখায়নি ঠিক তেমনই নিহত এবং আহতের সংখ‍্যা নিয়ে যাতে ধোঁয়াসা তৈরী হয় সে জন‍্য এই সংক্রান্ত কোনও তথ‍্য ঘটনার ১২ ঘন্টা পরেও দেয়নি যোগী সরকারের প্রশাসন। বুধবার বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পর উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে জানানো হয় পদপিষ্টের ঘটনায় ৩০ জনের মৃত‍্যু হয়েছে। জখম ৬০। স্বজনহারা পরিবারের সদস‍্যদের ক্ষোভ কোথায় গেলে দেহ মিলবে সেই টুকু তথ‍্য-ও সরকারি ভাবে দেওয়া হচ্ছে না। যারা জখম হয়েছেন তাদের কোথায় চিকিৎসা চলছে সে বিষয়েও কোনও তথ‍্য দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে দুর্বিসহ দশা যারা পরিজনদের খুঁজেই পাচ্ছেন না তাদের। অভিযোগ, থানা থেকে থানা ঘোরানো হচ্ছে তাদের। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। যদিও প্রয়াগরাজের ডিআইজি বৈভব কৃষ্ণ রাতে জানান, সব নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। পূণ‍্য স্নান ফের শুরু হয়েছে তবে কিছু বিধি নিষেধ আরও বাড়ানো হয়েছে কিন্তু কার বা কাদের গাফিলতিতে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল? এর উত্তরে ডিআইজি-র উত্তর তদন্ত চলছে।

মহাকুম্ভে আকাশ থেকে কয়েকশো টন গোলাপ ফুল ছড়ানোর জন্য হেলিকপ্টার মজুত ছিল কিন্তু আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ছিল না ।

কি ঘটেছে
গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতী— তিন নদীর সঙ্গমে মৌনী অমাবস্যায় শাহি স্নান! পূণ‍্য সঞ্চয়ে কোটি কোটি মানুষের ভিড় প্রয়াগরাজে আর সেখানেই ঘটল ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে মৃত‍্যু হল ১৫ জনের। আশঙ্কাজনক অনেকে। ফলে মৃতের সংখ‍্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা বলাই যাচ্ছে না। তখন রাত ১ টা থেকে ২ টো। সঙ্গমের কাছে ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় ব্যারিকেড। মানুষ তখন দিশাহীন ভাবে এগোচ্ছে স্রোতের মতো। একেবারে উত্তাল ঢেউয়ের গতিতে। কে কোনদিকে যাবেন, দিক নির্দেশ ছিল না। ছিলনা পর্যাপ্ত আলো অথবা প্রশাসনিক তরফে কোন ঘোষণা। সকলেই সকলের আগে স্নান করার জন্য যখন এগিয়ে চলেছেন সেই সময় হুড়োহুড়ি এবং তার জেরে ব্যারিকেড ভাঙার ফলে তীব্র আতঙ্কে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পদপিষ্ট হন বহু মানুষ। তবে বহু প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্বজন হারানো তীর্থযাত্রীদের অভিযোগ, লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী যখন গভীর রাতে শুয়েছিলেন শাহি স্নানের অপেক্ষায়, সেই সময় উত্তর প্রদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে একসঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের হ্যান্ড মাইক থেকে ঘোষণা করা হয় স্নানের সময় হয়ে গিয়েছে। আর এই ঘোষণা শোনা মাত্র দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা তীর্থযাত্রীরা মহাপুণ্য লাভের আশায় সকলে একসঙ্গে সাগর সঙ্গমের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। তখনই ঘটে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ১৫ জনের দেহ ঘাট থেকেই উদ্ধার হয়। বাকি যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ‍্যে সম্ভবত অনেকে হাসপাতালের পথে বা হাসপাতাল পৌঁছে প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে মৃতের সংখ‍্যা ৫০ ছাড়াতে পারে। পরিস্থিতি এমন যে উদ্ধারকাজে নামানো হয়েছে র‍্যাফ, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল এমনকি এনএসজি-কে। আখড়াগুলোতে আপাতত স্নান বন্ধ রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি ঘাটে সীমিত পূণ‍্যার্থীদের স্নানের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

কদিন আগেই লেগেছিল আগুন
গত ১৯ জানুয়ারি কুম্ভমেলায় আগুন ছড়িয়েছিল। ১৯ নম্বর সেক্টরে গীতা প্রেসের তাঁবু জ্বলে উঠেছিল দাউদাউ করে। সেখান থেকে আশপাশের কিছু তাঁবুতেও আগুন ছড়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০টিরও বেশি তাঁবু। তাঁবুগুলির ভিতর থেকে পর পর সিলিন্ডার ফাটার শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল। ভয়াবহ সেই আগুন তীর্থযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করলেও দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত দেখা মেলেনি দমকলের কোন গাড়ির।
জাতীয় মেলা হওয়া সত্ত্বেও এত অব্যবস্থা কেন
কুম্ভ মেলাকে আগেই জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ প্রত্যেক বছর গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে বাংলায় এক কোটির বেশি মানুষ স্নান করতে আসলেও গত এক দশকে সেখানে কোন বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং বিশ্বের বহু জায়গা থেকেও গঙ্গাসাগরে স্নান করতে তীর্থযাত্রীরা আসেন প্রতিবছর। বাংলার সরকারের বারংবার আবেদনের প্রেক্ষিতেও গঙ্গাসাগর মেলাতে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দেয় নি মোদি সরকার। কদিন আগেই শেষ হয়েছে গঙ্গাসাগর মেলা। গঙ্গাসাগর মেলাতে এবারেও কোটির বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিল। গঙ্গাসাগর মেলা থেকেই এ প্রসঙ্গে একাধিকবার মমতা বলেন, গঙ্গাসাগর মেলা কুম্ভ মেলার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এখানেও এখন কোটি মানুষের ভিড় হয়। তবু গঙ্গাসাগর মেলাকে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দিচ্ছে না কেন্দ্র।
যোগীকে ফোন মোদি-শাহের
কুম্ভমেলাকে প্রথম থেকেই ভাজপা রাজনৈতিক লাইনে ব‍্যবহার করতে চাইছে। কুম্ভমেলা উপলক্ষ‍্যে বিরাট আয়োজন, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাকে হাইলাইট করে প্রচারে কোনও খামতি রাখেনি যোগী সরকার-ও। ভাজপার একাধিক হেভিওয়েট নেতা কুম্ভে ডুব দিয়েছেন। জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ২.৩০ নাগাদ দুর্ঘটনা ঘটার পর ভোরেই আদিত‍্যনাথকে ফোন করেন মোদি। একবার নয় তিন তিন বার।
সব হয়েছে গুজবে – সাফাই যোগী আদিত্যনাথের
বার বার যখন কুম্ভের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, মানুষের মৃত‍্যু হচ্ছে তখন সব দায় গুজবের ওপর ছাড়লেন যোগী। যোগী আদিত‍্যনাথ বলেন, অনেক রকম গুজব রটছে। কোনো গুজবে কান দেবেন না। পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলুন।
সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন – মত শোকার্ত মমতার
মহাকুম্ভের পদপিষ্টের ঘটনায় শোকপ্রকাশ করে সঠিক পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল বলে জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীও। মমতা বলেন, মহাকুম্ভে মর্মান্তিক পদপিষ্টের ঘটনায় আমি গভীরভাবে শোকাহত। যে ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত পুণ্যার্থীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। গঙ্গাসাগর মেলা থেকে আমি শিখেছি যে বিশাল জনসমাবেশে যেখানে পুণ্যার্থীদের জীবন জড়িত থাকে, সেখানে পরিকল্পনা এবং পরিষেবা সর্বোচ্চ হতে হবে। মৃতদের আত্মার জন্য শান্তিকামনা করছি। মমতার পাশাপাশি কুম্ভ মেলায় ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যস্ত থেকে যোগীপ্রশাসন সাধারণ তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার দিকে নজর দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন রাহুল গান্ধী। রাহুল বলেন, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ভিআইপিদের দিকে নজর দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে আপোষ করার ফলে এত মানুষের মৃত‍্যু হল। আশা করব, এই ঘটনা থেকে যোগী সরকারের প্রশাসন শিক্ষা নেবে।
উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের অভিযোগ, যোগী আদিত‍্যনাথ সরকার প্রথম থেকে কুম্ভমেলা নিয়ে প্রচার করে আসছে। সবসময় বলা হচ্ছিল কুম্ভের জন‍্য এমন সব অভিনব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যা কিনা অভূতপূর্ব। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অন‍্য ছবি। কখনও তাঁবুতে আগুন লেগে যাচ্ছে কখনও লোক পদপিষ্ট হয়ে নিহত হচ্ছে। আসলে সবটাই লোক দেখানো প্রচার। পূণ‍্যার্থীদের নিরাপত্তার কোনও ব‍্যবস্থাই করা হয়নি। সবটাই ভগবানের নামে ছাড়া হয়েছে।

Scroll to Top