সৃজিতের সিনেমা ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই
বিশ বছরে বাংলায় এমন দেখিনি

পূষন গুপ্ত’র কলম
এসভিএফ কে অনুরোধ, ‘সত্যি…’ বিদেশি ফেস্টিভ্যালে পাঠান মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির শেকড় উপড়ে দিয়েছে নন লিনিয়ার ফরম্যাটে, পুরস্কৃত হবে

পূষন গুপ্ত

১. শুনলাম সৃজিতের এই ছবির অনুপ্রেরণা টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’। সাদা কালো ছবিটি ছোটবেলায় গ্লোব সিনেমা হলে দেখা। ভাল লাগেনি, বুঝিনি হয়তো, ভার্বোস মনে হয়েছিল। কথার পিঠে কথা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্ন্যাপি রেপার্টি’। পরে ছবি দেখতে বসে টাইটেল কার্ডে দেখলাম ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’র কথাও বলা হয়েছে। হবে হয়তো, দেখিনি ছবিটা। সত্যি বলতে কী, সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণায় আমার কিছু যায় আসে না। অ্যাডাপটেশনের ক্ষেত্রে মূল কাঠামোকে রেখে অনেক কিছু করা সম্ভব। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে এমন বহু উদাহরণ দিতে পারি যা অ্যাডাপটেশনের পরেও অরিজিনালকে ছাপিয়ে গেছে। সাহিত্য, সিনেমা, নাটক, চিত্রকলা বা সঙ্গীতে এমন অহরহ ঘটে এবং সেটাই স্বাভাবিক। প্রথমেই বলে রাখা ভাল, সৃজিতের ‘সত্যি …’ আদ্যন্ত একটি অরিজিনাল ছবি যা সিডনি লুমিয়েটের তোলা ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’এর থেকে ঢের ভাল, দশ গোল দিলেও অবাক হব না। প্রসঙ্গত আরও বলে রাখি, সিডনি লুমিয়েটের ছবিও আসলে অরিজিনাল নয়।২. সৃজিতের ছবির প্রথম ধরতাই হল এর কোনও ন্যারেটিভ গপ্পো নেই। সূত্রটি সামান্য, মামলা হয়েছে একটি বস্তির ছেলেকে নিয়ে যে তার দাদাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত। জজ সাহেব স্বয়ং ছেলেটিকে দোষী ধরে নিয়ে এগোচ্ছেন। আদালতে জুরির বিচার এদেশের বিচারব্যবস্থা থেকে উঠে গেছে যদিও তবু আরও ১১ জনকে নিয়ে ১২ জন যুক্তি ও তর্কে নেমেছেন, ছেলেটির অপরাধ বিচারে। ছবির নন ন্যারেটিভ ফরম্যাটকে আমি কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে চাই,

(ক)  এই দ্বাদশ অশ্বারোহী কি সমাজের প্রতিনিধি, সচরাচর যেমন হয়ে থাকে? না, কেন না এরা বিভিন্ন পেশা থেকে এলেও অনেকেই হয়তো জাস্টিসের আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব। নিজের মেয়ে, নিজের সেক্রেটারি, নিজের হাবুলদা, নিজের ইকোনমিস্ট (চোখে সারাক্ষণ আই ড্রপ দিতে হয় যাকে, চোখে ব্যারাম নিয়ে ন্যায়বিচার করতে বসেছে তো!) বন্ধু। আলো আঁধারি লিঙ্ক আছে কিন্তু। কেবল ফ্যাশন ডিজাইনার, ট্রান্সজেন্ডার বলেই মনে হচ্ছে আর জয় শ্রীরামের কপালে তিলক আর গেরুয়া পরা লুম্পেন ভক্তটি, দুজনেই এই সমাবেশে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ এরা মধ্যবিত্ত অর্থে সমাজের প্রতিনিধি নন।

(খ)  গোটা ছবিতে একটি খন্ড দৃশ্য ছাড়া কোর্ট রুম নেই। অথচ ছবিটি কোর্ট রুম ড্রামা। আদলতের টেকনিক্যাল ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে বটে, কম। জুরি বোর্ড কোথায় বসে ? কোর্ট অ্যাটাচড চেম্বারে? কোনও ভাড়া করা কনফারেন্স রুমে? জাস্টিসের ড্রইংরুমে? না। এসব জুরি কনফারেন্স ছবিতে বসেছে, মধ্যরাতে ফ্লাইওভারে, গলফ কোটে, গভীর জঙ্গলে অথবা সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া বালুকাবেলায়। সবকটি লোকেশনে থ্রোন সদৃশ হাইব্যাক চেয়ারে বসে জুরি সদস্যরা। কেন এই বিচারসভা, কেন এই তীব্র ক্ষুরধার যুক্তি, তর্ক ও বিতর্ক সমাবেশ বারবার এই সব নন লিনিয়ার, তুলনামূলক ভাবে সুররিয়াল লোকেশনে? প্রশ্ন উঠতে পারে, দর্শকের র‍্যাশানালিটি আক্রান্ত হতে পারে। মনে হতে পারে, আপনি মধ্যবিত্ত বাঙালি আটপৌরে বহুরূপী দেখে খুশি হওয়া দর্শক, আপনাকে একটা ঘোরতর বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে পরিচালক। এটি কোনও অশ্রুসজল, পৌরাণিক, ফিল গুড ফ্যামিলি ড্রামা বা তারাশঙ্করের গল্প নির্ভর বা উত্তম সুচিত্রা অভিনীত ম্যাটিনি টাইম ‘বই’নয়। আপনার পড়া থাকলে মনে হতে পারে পিরানদেল্লো, আয়নেস্কো বা এডওয়ার্ড অ্যালবির অর্থাৎ কোনও এক অ্যাবসার্ড থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়েছেন। যা দেখছেন, যা শুনছেন, তা আপনার পরিচিত মেধা, বিদ্যেবুদ্ধি, জ্ঞান বা লজিকাল অনুষঙ্গের আওতায় পড়ে না। ঢেউ ভেঙে পড়ছে থ্রোন সদৃশ হাইব্যাক চেয়ারের পায়ায়। ছোট করে চুল কাটা নারীবাদী মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন অবাঙালি ব্যবসায়ী, প্রশ্ন করছেন বলুন কেন আপনার এই পুরুষ বিদ্বেষ ? আপনার নৈর্ব্যক্তিক বিচারবোধ ইতিমধ্যেই কি নষ্ট হয়ে যায়নি? ভেঙে পড়া ঢেউয়ের মধ্যে নতজানু মেয়েটি বসে পড়ছে। এই দৃশ্যের জন্য সমুদ্রই দরকার ছিল। শ্রেষ্ঠ লোকেশন নির্বাচন সৃজিতের।

(গ)  লক্ষ করুন সবকটি লোকেশনে একটি অতিরিক্ত ডায়মেনশন তৈরি করে ঈশ্বর অথবা শয়তানের মতো জাস্টিস তার নিজস্ব লোকজনদের নিয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থাৎ ওই জুরি বোর্ডের বিচারসভায় জাস্টিস যতই তর্ক বিতর্ক করুন না কেন আসলে তিনি তার দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রভাব খাটিয়ে চলেছেন প্রেক্ষাপটে। কখনও গলফ কোর্সে, গলফ স্টিক হাতে, কখনও জঙ্গলে বাইনোকুলার হাতে অরনিথোলজিস্টের চরিত্রে, কখনও ফ্লাইওভারে এসইউভি গাড়ি থেকে নেমে …। আমি তারে পারি না এড়াতে। এই নাকি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা। এই চলচ্চিত্রের ভাষা সৃজিত গ্রহণ করেছেন বের্টোল্ট ব্রেখটের থিয়েট্রিকাল ভাষা থেকে। যা আমাদের এলিয়েনেশনকে ভাঙে, ভেঙেই চলে গোটা ছবিজুড়ে। গত বিশ বছরে এমন একটি ফর্ম ভাঙা বাংলা ছবি দেখিনি কখনও।

(ঘ)  সৃজিত ছবিতে একটি বাউল এবং একটি দরবেশ (কাওয়ালি) সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। একটি গান বলে তোমার মাথার মধ্যে বাস করে কয়জনা। কাওয়ালি গানটিও দেহতত্ত্বের সেই একই কথা বলে। যুক্তি, তক্ক ও গল্পের এই গোলকধাঁধায় একদিকে বাউল অন্যদিকে দরবেশি কাওয়ালির ব্যঞ্জনাবহ ব্যবহার তীব্র তীক্ষ্ণ ও সামাজিক। বুঝ লোক, যে জান সন্ধান ।

(ঙ)  আথেন্সে অ্যাক্রোপলিসে ওঠার পথে একটি পাথরের চাট্টান আছে। চাট্টানটির গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ বিশ্বের প্রথম বিচারসভা বসে সেখানেই। গ্রিক পুরাণবিদ র‍্যাডাম্যানথাস এবং পরবর্তীকালে দার্শনিক প্লেটো দুজনেই সওয়াল করেছিলেন, চোর পাকড়ে আগে থেকেই তার হাত কেটে দিচ্ছ কোন বিচারে? আগে তার দোষ প্রমাণিত হোক। তার বক্তব্য শোনা হোক। জনগণ বিচার করুক, যুক্তি তর্ক করে দেখুক, সত্যিই সে অপরাধী কিনা? তবে তো দোষের শাস্তি। বিচারসভার সেটাই তো শুরু। সৃজিতের ‘সত্যি…’ ছবিটি সেই আদি বিচারসভার গল্পই তো বলে গেল আগাগোড়া। ফ্যাশন ডিজাইনার তথা বিবেক তথা ডিফেন্স কাউন্সিল তো সেই অমোঘ সত্যের দিকেই হাত ধরে নিয়ে গেল সকলকে, যেখানে জুরি বোর্ডের ভোট ১১-১ থেকে ১–১১ তে বদলে যায়, প্যারাডাইম শিফট ঘটে। যুক্তি তর্ক যত ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে, তত হিংস্র হয়ে ওঠে জয় শ্রীরামের মুসলমান বিদ্বেষী রাজনীতি। ধন্যবাদ পরিচালককে। ওই নির্মম, পশুসুলভ হিংস্র কমিউনাল কুযুক্তিকে আক্রমণ করতে হলে জামার কলারই চেপে ধরতে হয়। সভ্য ভাষা ওদের জন্য নয়।

৩. এই নির্মম, লজিকাল, ইমোশনহীন নন লিনিয়ার ন্যারেটিভটি দেখ তে বসে পরিচালকের পাশাপাশি তারিফ, হাততালি দিতে হয় ৩ অভিনেতার উদ্দেশ্যে। দশে দশ পেয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনারের ভূমিকায় পরমব্রত। চেনা ট্রান্সজেন্ডার চরিত্র, মুহূর্তের জন্য ক্যারিকেচার নেই, এক অভিনয়ের দাপট এতটাই যে অতি বড় হোমোফোবিক, উন্নাসিক দর্শকের ঠোঁটের কোণেও সামান্যতম বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠেনি, প্রত্যেককে মন দিয়ে শুনতে হয়েছে, ভয় পেতে হয়েছে ওর যুক্তির তরবারি প্রদর্শন। চিত্রনাট্য যতই সাপোর্ট দিক, দুর্দান্ত অভিনয় ছাড়া এই ভয়ঙ্কর ধারালো, বুদ্ধিবৃত্তির র‍্যাশানালিটি প্রকাশ অত সোজা নয়। ব্যক্তিত্ব থেকে স্বর্গীয় আলোর দীপ্তি ছড়াচ্ছে যেন। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, পরমব্রত’র চরিত্রের প্রতিটি এফিমিনেট মুদ্রা অভূতপূর্ব ব্যক্তিত্ব নিয়ে কশাঘাত করছে। বাংলা ছবি অস্কারে না গেলেও, কান, ভেনিস বা বার্লিন উৎসবে যেতে পারে, এই ছবির তো যাওয়া উচিতই। এবং গেলে পরমব্রত এইসব বিখ্যাত এবং যথার্থ চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাবেন, আমি নিশ্চিত। পাশাপাশি দ্বিতীয় দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন। বড় পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি। কৌশিক কিছুদিন ধরে দেখছি প্রচুর ছবিতে অভিনয় করছেন। আমি দু একটি দেখেওছি। বড় পরিচালকরা সবসময়ই ভাল অভিনেতা তাতে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু জাস্টিসের চরিত্রে কৌশিক এই ছবিতে এক্সেল করেছেন। তার জাস্টিস চরিত্রের ইডিওসিনক্রেসিস, হাউলিং, ডমিনেন্স, বায়াসনেস এবং ট্র্যাজেডি করার মতো অভিনেতা এই মুহূর্তে বোধহয় বাংলা ছবিতে খুব বেশি কেউ নেই। তৃতীয় পুরস্কারটি পাবেন অবশ্যই ঋত্বিক। ‘জয় শ্রীরাম’ চরিত্রের দাঙ্গাবাজ, আগলি, লুম্পেন ও কুযুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার হিংস্রতা দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়, অথচ সে তথাকথিত ভিলেন নয়।

8. প্রযোজক-পরিচালককে অনুরোধ, বাংলা ছবির দর্শকদের কথা না ভেবে, অন্তত এই শিল্পসম্মত ছবিটিকে বিশ্বের বড়মাপের চলচ্চিত্র উৎসবে নিয়ে যান। তাদের অবশ্যম্ভাবী স্বীকৃতি অর্জন করুন। তাতেই বাংলা ছবির স্বাস্থ্য ফিরবে।
পুনশ্চ
সম্প্রতি আরজি কর ও অন্যান্য নানাবিধ ইস্যুতে এই ছবির সঙ্গে যুক্তদের রাজনৈতিক তথা সামাজিক কমেন্টের একটিকেও আমি সমর্থন করিনি, উল্টে আক্রমণ করেছি, ভবিষ্যতে এমন হলে আবার করতে বাধ্য হব। কিন্তু মহৎ শিল্প ও মহৎ শিল্পীদের সামনে নতজানু হয়ে টুপি খুলে দাঁড়াতে হয়। অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস আমাকে এটাই শিখিয়েছে। একেই বোধহয় ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে। ছবিও তো আসলে পোয়েটিক জাস্টিসের কথাই বলে শেষপর্যন্ত।

Scroll to Top