বাঘিনী জিনাত বাঁকুড়ায় ধরা পড়ল
সুস্থই আছে জিনাত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আনা হল আলিপুরে
অশোক কুমার মণ্ডল, রজতশুভ্র চট্টোপাধ্যায়
৩৬৫ দিন। দিন কুড়ি ধরে বনদফতরকে ঘোল খাইয়ে অবশেষে বনদফতরের হাতে ধরা পড়েছে বাঘিনী জিনাত। জিনাতের কিস্যা শুরু হয়েছিল মহারাষ্ট্রে আর শেষ হল ১৪৮২ কিলোমিটার দূরের বাঁকুড়ায়। অবশ্য এই বিশাল দূরত্ব যে জিনাত পদব্রজে পাড়ি দিয়েছে এমন নয়। মহারাষ্ট্র থেকে ওড়িশায় বনদফতর-ই তাকে নিয়ে আসে তারপর থেকে অবশ্য আর বনদফতরের ইচ্ছেয় নয় নিজের মর্জিতে সে ঘুরে বেড়িয়েছে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, জঙ্গল থেকে জঙ্গলে। সাম্প্রতিক সময়ে এত বেশী দিন ধরে এই ভাবে বনদফতরকে নাকানিচোবানি খেতে হয়নি কোনও বাঘিনীর খপ্পরে পড়ে। তবে সব যে ভালোয় ভালোয় মিটেছে তাতেই স্বস্তি। মহারাষ্ট্র থেকে ওড়িশা, তারপর নিরুদ্দেশ চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে তিন বছরের জনিতকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে (টাইগার রিজার্ভ, সংক্ষেপে বা এসটিআর) আনা হয়েছিল।কয়েক দিন ঘেরাটোপে রেখে পর্যবেক্ষণের পরে রেডিয়ো কলার পরিয়ে ২৪ নভেম্বর তাকে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ছাড়া হয়েছিল। এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু ২৫ নভেম্বরের আশেপাশে আচমকাই ভ্যানিস হয়ে যায় জিনাত। গলায় পরানো রেডিও কলার থেকে তেমন কোনও সিগন্যাল-ও মিলছিল না। প্রথমটায় সিমলিপালের আধিকারিকরা ভেবেছিলেন কোনও ভাবে হয়তো রেডিও কলার বিগড়েছে অথবা বাঘ রয়েছে এমন জায়গায় যেখানে সিগন্যাল মজবুত নয় কিন্তু ভুল ভাঙে বেশ কয়েকদিন পর যখন দেখা যায় কয়েকশো কিলোমিটার জঙ্গল ভেঙে জিনাত পৌঁছে গিয়েছে ঝাড়খণ্ডে। বনদফতর যখন জিনাতের নাগাল পায় তখন সে বাংলার ঝাড়গ্রামে ঢুকবো ঢুকবো করছে। কয়েক দিন ঝাড়খণ্ডে ঘুরে চাকুলিয়া রেঞ্জের রাজাবাসার জঙ্গল পেরিয়ে চিয়াবান্ধি দিয়ে সে সোজা ঢুকে পড়ে বাংলার ঝাড়গ্রামে। অবশ্য ততোদিন দিন তিনেক কেটে গিয়েছে।
ঝাড়গ্রামে জিনাত-আতঙ্ক
নভেম্বর মাস জুড়ে ঝাড়গ্রাম তটস্থ ছিল রামলালের দাপাদাপিতে। কখনও সে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে তো এই আইসিডিএসের চাল চুরি করে। দাঁতাল হাতির তাণ্ডবে যখন বনদফতর অতিস্থ ঠিক তখন নতুন উৎপাত। খবর আসে জিনাত ঢুকে পড়েছে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থানার অন্তর্গত কাটুচুয়া জঙ্গলে। ঝাড়খণ্ড-বাংলার বনদফতরের বিশাল টিম খাঁচা টোপ নিয়ে হাজির হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় কি! বাঘিনীর টিকিটির-ও দেখা মেলেনি। টোপের মোষ, ছাগল ছুঁয়েও দেখেনি সে। এদিকে শীতের শুরুতে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির ওই অংশে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে। হোম স্টে, হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। বাঘ পড়েছে শুনে মাথায় হাত হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি খবর আসে জিনাত ওড়িশার দিকে ফিরে যাচ্ছে। বনদফতর যখন হাফ ছাড়ছে যাক নিরুপদ্রপে বাঘিনী ডেরায় ফিরছে ঠিক তখন মাইন্ড চেঞ্জ জিনাতের। মুখ ঘুরিয়ে সে ফের হাঁটা দেয় বেলপাহাড়ির দিকে। ফের জাল, টোপ, শিকারী, মাইকিং ফেরে। দিন তিনেক এমনই চলে। তারপর জিনাত বড়দিনের মরসুমে বেঙ্গল সাফারির দ্বিতীয় ভাগে ডেরা জমায় শীতের পুরুলিয়ায়।
রাইকায় জিনাত
২৫ ডিসেম্বর নাগাদ বনদফতর জানায় জিনাতের রেডিও কলারের সিগন্যাল বলছে সে বেলপাহাড়ি থেকে ডেরা জমিয়েছে বান্দোয়ানে। সম্ভবত অযোধ্যা পাহাড়ে যাচ্ছে সে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অযোধ্যা পাহাড় না গিয়ে রাইকা পাহাড়ে ডেরা জমায় বাঘিনী। ফের টোপ দিয়ে তাকে জালবন্দি করার চেষ্টা হয় তবে সে সব মাঠে মারা যায়। আসলে ব্যাপার হল রাইকা আর তার আশপাশের জঙ্গলে শিকারের ছড়াছড়ি। বুনো শুয়োর, বনবিড়াল কি নেই! আর সহজলভ্য ছাগল তো আছেই। জঙ্গল লাগোয়া বেশ কিছু গ্রামের কয়েকজন আবার দাবি করে তাদের গরু ছাগল সাবাড় করেছে জিনাত। বনদফতর অবশ্য জানায় যে পরিমাণ গবাদি পশু নিখোঁজ বলা হচ্ছে এত মাংস বাঘ একা খেতে পারে না। অভিযোগ ওঠে জিনাতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কয়েকজন দু পয়সা কামাতে চাইছে! সে যাই হোক, দুদিন পর জিনাত বান্দোয়ান ছেড়ে ঢুকে পড়ে মানবাজারে। সেখান থেকে সফরের শেষ ভাগে রাঢ় বাংলার বাঁকুড়া।বাঁকুড়ায় বাঘবন্দি
২৭ ডিসেম্বর ভোরে বনদফতর জানায় জিনাত ওড়িশার দিকে যাওয়ার বদলে ঢুকে পড়েছে মল্লভূম বাঁকুড়ায়। শেষ লোকেশন মুকুটমণিপুর। এখানকার জলাধার থেকে নাকি তাকে জল খেতে দেখে পড়িমরি করে দৌড়ে রিপোর্ট করেছে সেখানকার গ্রামবাসীরা। পায়ের ছাপ ও নাকি মিলেছে। বনদফতর এবার নামে চুড়ান্ত অভিযানে। বনদফতরের কর্তারা জানান, বাঁকুড়া থেকে বাঘিনী ধরা সবচেয়ে সহজ। এবার সুযোগ ফস্কালে কপালে চরম দুর্গতি রয়েছে। কারণ, বাঁকুড়ার একদিকে হুগলি, অন্যদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর। একবার ওই সব এলাকায় ঢুকলে ঝকমারির শেষ নেই কারণ সেখানে জনঘনত্ব থিকথিকে। বাঁকুড়ার রানিবাঁধ থানার গোঁসাইডিহি গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে জিনাত আশ্রয় নিয়েছে নিশ্চিত হতেই আদাজল খেয়ে নামে বনদফতর। জঙ্গলে ঢুকে শুরু হয় অভিযান। শনিবার রাত ১ টা এবং রাত ৩ টে দু’দুবার জিনাতকে বাগে পেয়েও নিশানা ফস্কান বনদফতরের শিকারী। শেষ পর্যন্ত সাফল্য মেলে রবিবারের বারবেলায়। চতুর্থবারের চেষ্টায় গুলিতে ঘুমিয়ে পড়ে জিনাতের। বুলডোজারে তোলা হয় জিনাত বন্দি খাঁচা।