পুতিনের ঘোষণা, ২০২৫’এ সকল রুশ নাগরিকদের ভ্যাকসিন
৩৬৫ দিন। চাঁদে মানুষের পদার্পণ নয়,এটাই শতাব্দীর সেরা আবিষ্কার, আমরা ক্যান্সারের উত্তর পেয়ে গিয়েছি। দীর্ঘ দিনের গবেষণা সফল হল আমাদের সেরা বিজ্ঞানীদের জন্যই। যাঁরা নোবেল প্রাইজের জন্য লালায়িত নয়, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজেদের নিবেদিত করেছেন। ১৮ তারিখ ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে ছয়টায় রাশিয়ার জাতীয় সংবাদমাধ্যম তাস এ পুতিনের এই ঘোষণা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়। ৭০/৮০ বছর ধুরে যে মারণ অসুখের উত্তর খুঁজে চলছে আধুনিক বিজ্ঞান, উন্নততর মেডিক্যাল সায়েন্স ও রসায়নবিদ্যার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেও আজও অধরা সে মৃতসঞ্জীবনীর সূত্র,সেই গোলকধাঁধার দরজা খুলে দিল রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা দ্যা ল্যানসেট,জার্নাল অফ ক্লিনিকাল এপিডেমিওলজি, জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসসিয়েশনের মত পত্রিকার বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারকে কেবল গুরুত্বই দেয়নি,একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন এভিনিউ খুলে গেল। যদিও এই ভ্যাকসিন কোনও নির্দিষ্ট কোনও ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কিনা তা বিশ্লেষণ করেনি ক্রেমলিনের। পুতিননের আরও চাঞ্চল্যকর ঘোষণা, আগামী বছরের শুরুতেই নাকি তারা বিনামূল্যে ক্যানসারের টিকা দেওয়া শুরু করবে। আর তা বিতরণ করা হবে একদম নিখরচায়। যা শুরু হবে ২০২৫ সালের শুরুর দিকেই। তারপর বহির্বিশ্বের হাতে পৌঁছবে এই টিকা। গামালেয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের কর্তা বিজ্ঞানী ড আলেকজান্ডার গিন্সবার্গের দাবি, ক্যানসারের টিকার প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে দেখা গিয়েছে যে কোনও টিউমারের, কোষের অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা এবং মেটাস্টেস অর্থাৎ ক্যানসারের ছড়িয়ে পড়া রুখে দিচ্ছে এই টিকা।আড়াই বছর ধরে এই ট্রায়াল চলছিল বিভিন্ন স্টেজের ক্যান্সার আক্রান্তদের ওপর। এবার সাফল্য এল। প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের গোড়াতেই তিনি বলেন, ক্যানসারের টিকা তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন রুশ বিজ্ঞানীরা। এবার সামনে এল সেই সংক্রান্ত আরও বড় দাবি। এদিকে গিন্সবার্গ বলছেন, এআই সংক্রান্ত গবেষণা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এক ঘণ্টায় এই ধরনের টিকা বানিে ফেলতে পারে।রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ রেডিওলজি মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের জেনারেল ডিরেক্টর ড আন্দ্রে কাপ্রিন আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে বলেছেন, এটি মূলত আরএনএ ভ্যাকসিন। একবারই নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়তে কোষের নিজস্ব একটা ইমিউনিটি সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধের শিল্ড গড়ে ওঠে। এর আগে আমরা কোভিড ১৯ ভাইরাসের প্রতিষেধক স্পুটনিক আবিষ্কার করেছি,কোটি কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে সেই ভ্যাকসিনে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়াতেও ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০২২ সালে রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, রাশিয়াতে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষের বেশি। কোলন, স্তন ও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলেই জানিয়েছিল রাশিয়া।
কিভাবে কাজ করবে এই ভ্যাকসিন
এই আবিস্কারের অন্যতম কান্ডারী বিজ্ঞানী ড আলেকজান্ডার গিন্সবার্গ বলেছেন, এমআরএনএ বা ম্যাসেঞ্জার আরএনএ থেকে তৈরি এই টিকা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে রোগ প্রতিরোধী কোষগুলির। ক্যানসারের কোষগুলিকে চিহ্নিত করে খতম করা শুরু করবে। তৈরি করবে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি। ক্যানসারের মতো মারণরোগ নিয়ে বিচলিত সারা বিশ্ব। সম্প্রতি লন্ডনের নর্থ ওয়েস্টার্ন মেডিসিন ক্যানিং থোরাসিক ইন্সটিটিউট ক্যানসার সংক্রান্ত গবেষণায় অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে বিশ্বখ্যাত জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন-এর নভেম্বর সংখ্যায়। জার্নালের তথ্য বলছে, যেসব টিউমার থেকে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল সেইসব রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা বিস্ময়করভাবে বাড়িয়ে দেয় করোনা ভাইরাস। ফলত ইউরোপের দেশগুলিতে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের টিউমারকে নিস্ক্রিয় করতে এই নতুন থেরাপি দিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও শুরু হয়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে স্তন, লিভার, ফুসফুস, কোলন এবং ম্যালানোমা ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে দারুণ কাজ করে করোনা। এই পরিস্থিতিতে এবার ক্যানসারের টিকা আনার দাবি করল রাশিয়া।বর্তমানে রাশিয়া ছাড়াও অনেক দেশ এবং সংস্থা ক্যানসারের টিকা নিয়ে কাজ করছে। হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস-এর বিরুদ্ধে বর্তমানে ছ’টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিকা রয়েছে। এই ভাইরাস জরায়ুমুখের ক্যানসারের কারণ। এইচপিভি টিকা জরায়ুমুখের ক্যানসার তো প্রতিরোধ করেই, তা ছাড়াও আরও কয়েক রকম ক্যানসার থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে বলে দাবি। আরও একটি প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গিয়েছে, যেটি হেপাটাইটিস বি-এর টিকা। এই প্রতিষেধক লিভার ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে বলে দাবি। এ ছাড়াও প্রস্টেট, ব্লাডার, কিডনির ক্যানসারের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু সে সব প্রতিষেধক এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আছে বলেই জানা গিয়েছে।পিছিয়ে নেই আমেরিকা জার্মানি
ক্যান্সার চিকিৎসার উপায় খুঁজতে পিছিয়ে নেই আমেরিকা,জার্মানের মত মেডিক্যাল সায়েন্স উন্নত দেশগুলো। একই সঙ্গে ছুটছে জাপান। সম্পত্তি ব্রিটেন জার্মান কোম্পানি বায়ো-এনটেকের সাথে মিলে ক্যান্সারের টিকা তৈরি করছে। এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার রোগীর িকিৎসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, আমেরিকার মডার্না এবং মার্কের মতো কোম্পানিগুলিও ত্বকের ক্যান্সারের টিকা তৈরিতে ব্যস্ত। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকা এ ও এইচ ১৯৯৬ ওষুধের মানব পরীক্ষাও করেছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন যে ক্যান্সারের এই ওষুধ সুস্থ কোষের কোনও ক্ষতি না করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করবে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে ভারতে ১৪ লক্ষেরও বেশি ক্যান্সারের ঘটনা সামনে এসেছিল। এর মধ্যে ৭.২২ লক্ষ মহিলা এবং ৬.৯১ লক্ষ পুরুষের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। অন্যদিকে, ৯.১৬ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।
গুরুত্ব বাড়ল রাশিয়ার
১৯৫৫ সালের পর থেকে বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ গোটা বিশ্বের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,কূটনীতিক দিকগুলো ছাড়াও এই দুই সুপার পাওয়ারের একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় বিশ্ব হারানোর পাশাপাশি পেয়েছে অনেক কিছু। পরমাণু অস্ত্রের ঝনঝনানির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভিনব উন্নতিও হয়েছে। সভ্যতা মৃত্যুভয়ের সঙ্গে পেয়েছে মহাকাশ জয় করার দুঃসাহস। প্রথম মহাকাশযাত্রা থেকে চাঁদের মাটিতে পা রেখে মঙ্গল গ্রহের পথে সভ্যতা। উন্নত স্যাটেলাইট থেকে কমিউনিকেশন। উন্নত চিকিৎসা থেকে যোগাযোগ সবেতেই আমেরিকা আর রাশিয়ার ছিল টক্কর। যদিও ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ভাঙার শুরু থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল রাশিয়া। কোভিড ১৯ এর টিকা রাশিয়ার প্রথম ব্রেক। তারপরেই এই ক্যান্সার টিকা। সম্মানের লড়াইয়ে রাশিয়া আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশষজ্ঞরা। তাই পুতিন তাঁর ভাষণে চাঁদে মানুষের পদার্পণের থেকেও ক্যান্সার ভ্যাকসিনকে শতাব্দীর সেরা আবিষ্কার বলতে দ্বিধা করেননি। এটা একটা রুশ বিরধীদের জন্য তাঁর টিপ্পনী বলা চলে। যদি রাশিয়া এই ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে তাহলে গোটা বিশ্বের ওষুধ ব্যবসার একটা বড় লাভ তারা ঘরে তুলবে বলা যায়। যেমন স্পুটনিক ভ্যাকসিন থেকে ৩০৯ বিলিয়ন লাভ তারা করেছিল।