নিজেকে ঈশ্বরের দূত বলায় মহাপাতক মোদিকে শাস্তি দিলেন স্বয়ং রামচন্দ্র
ইন্দ্রনীল সাহা।৩৬৫দিন। কথিত আছে, ১৪ বছর বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফেরার পর খোদ সীতাকেও ছাড় দেয়নি অযোধ্যাবাসি। সতীত্ব প্রমাণ করতে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখে ঠেলে দিয়েছিল অযোধ্যাবাসী। এবার সেই অযোধ্যার মানুষ লোকসভা নির্বাচনে রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র মোদিকেও রেয়াত করল না। ফৈজাবাদ লোকসভা আসনে গোহারা হারতে হল ভাজপা প্রার্থীকে। অযোধ্যায় রামপথ নির্মাণের নামে হাজার হাজার মানুষের বসতবাড়ি ভেঙে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ভাঙা হয়েছে কয়েকশো দোকান। যেখান থেকে পেট চলতো অযোধ্যার বহু মানুষের। সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের চোখের জল ও ক্ষুধার দাম দিতে পারেনি ভাজপা সরকার। তাই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অযোধ্যা মোদির থেকে শুধু মুখই ঘোরায়নি,ভাজপাকে যোগ্য জবাবও দিয়েছে।
রামপথ নির্মাণে বুলডোজার চলেছেঅযোধ্যার নতুন ঘাট থেকে শাহাদত গঞ্জ। রাম মন্দিরের জন্য ১৪ কিলোমিটারের রাম পথ নির্মাণ করেছে যোগী সরকার। রাস্তা চওড়া করতে ১২ কিলোমিটার পথ জুড়ে ভাঙা হয়েছে কয়েক হাজার বাড়ি। ১২ টির ওপরে মসজিদ ও ৩০ টিরও বেশি মন্দির। শুধু তাই নয়, রামপথ নির্মাণে ধূলিসাৎ হয়েছে অসংখ্য দোকান। উত্তরপ্রদেশের ভাজপা সরকার রাম পথ নির্মাণের পর নতুন করে দোকান বসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েই উচ্ছেদ করা হয়েছিল অযোধ্যার মানুষদের। উচ্ছেদের সময় প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেও যোগী সরকারের হুমকির মুখে পড়ে পিছু হটতে হয়। অপেক্ষা ছিল শুধু ভোটের। তাই ভোট বাক্সে বিকাশের নামে ভাজপার বিনাশের জবাব দিয়েছেন অযোধ্যার মানুষ।
লাল্লু সিং অর্ধলক্ষ ভোটে পরাজিতফৈজাবাদ লোকসভা আসনে সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদের কাছে বিরাট ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেন ভাজপা প্রার্থী লাল্লু সিং।কিন্তু এই আসন থেকে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরপর ২ বার জিতে সংসদে গিয়েছিলেন লুলু সিং।অবধেশ প্রসাদ ৯ বারের বিধায়ক।পাশাপাশি তিনি সমাজবাদী পার্টির দলিত মুখগুলির মধ্যে অন্যতম। তিনি ভাজপা প্রার্থী লাল্লু সিংকে ৫৪,৪৬৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ সিং যাদব বলেন, আমি অযোধ্যা বাসীদের ধন্যবাদ জানাই। আপনারা সময়ে সময়ে অযোধ্যার যন্ত্রণা দেখেছেন। তাদের (জনগণ) তাদের জমির জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, তাদের জমি বাজার মূল্যে অধিগ্রহণ করা হয়নি, আপনি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে জোরপূর্বক তাদের জমি কেড়ে নিয়েছিলেন। আপনি একটি পবিত্র কাজের জন্য গরীবদের ধ্বংস করেছেন তাই আমি মনে করি অযোধ্যাবাসী এবং প্রতিবেশী এলাকাগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। জয়ের পর সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী অবধেশ প্রসাদ বলেন, গোটা দেশে বিজেপির খারাপ ফলাফলের কারণ হচ্ছে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, জমি অধিগ্রহণ এবং সংবিধানে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। অযোধ্যায় যেভাবে যোগী সরকারের উন্নয়নের নামে লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের বসতবাড়ি ভেঙেছে তার জবাব মানুষ ভোটের মাধ্যমে দিয়েছেন। রাম মন্দিরের মহিমা বহিরাগতদের প্রভাবিত করতে পারে, তবে শহরের বাসিন্দারা তাদের যে অসুবিধার শিকার হয়েছিল। রাম পথ নির্মাণের সময় স্থানীয়দের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে তাদের দোকান বরাদ্দ করা হবে কিন্তু তা হয়নি।এসপির বিজয়ী প্রার্থী আরও বলেন, বিজেপি সরকার মন্দির নির্মাণের অজুহাতে যে হাজার হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে, আমি তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করব।
মোদি ও যোগীর ঠান্ডা লড়াইয়ে হারআবার রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে অযোধ্যায় রামমন্দিরের নির্মাণ করে বিজেপি নির্বাচনে ফায়দা তুলতে চেয়েছিল।শুধু বাড়ি ভাঙাই নয়, নরেন্দ্র মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথের মধ্যে ঠান্ডা সম্পর্কও অযোধ্যা কিংবা উত্তরপ্রদেশে ভাজপার খারাপ ফলের জন্য দায়ী। প্রার্থী তালিকা নিয়েও যোগীর সঙ্গে অমিত শাহের বিবাদ তৈরি হয় বলেই জানা গিয়েছে। অমিত শাহের পছন্দের প্রার্থীদের উত্তরপ্রদেশের বেশকিছু কেন্দ্র থেকে টিকিট দেওয়ায় তাদের হয়ে যোগী আদিত্যনাথ এর গোষ্ঠী ভোটে কাজ করেনি।এদিকে,লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ভাজপার ব্যানার এবং পোস্টারে শুধুমাত্র মোদিরই মুখ ছিল। দিন কয়েক পরে অবশ্য সেই সব পাল্টে নতুন পোস্টার এবং ব্যানার ঝোলানো হয়। সেখানে দেখা যায় মোদি-যোগী দুজনেরই ছবি ছিল। নিজেদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই এর কারণে ফৈজাবাদের মতো আসনে প্রায় ৮০ শতাংশের উপর হিন্দু ভোটার থাকা সত্বেও ভাজপাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হল।
অযোধ্যায় মারওয়ারীদের প্রবেশরাম মন্দিরের নির্মাণের আড়ালে মারওয়ারিদের অযোধ্যায় প্রবেশ করিয়েছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে মন্দিরকে পর্যটনস্থল বানিয়ে আদতে মারওয়ারিদের বড় ব্যবসা সুযোগও করে দেওয়া হয়েছে । যার জেরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল ভাজপার বিরুদ্ধে। যার প্রতিফলন ঘটেছে ভোট বাক্সে।
মোদির বেনারসেও ভাজপার ধ্বংসলীলামোদির কেন্দ্র বেনারসেও বিশ্বনাথ মন্দিরের উন্নয়নের নামে কার্যত একইভাবে বুলডোজার চালিয়েছিল যোগীর প্রশাসন।বারাণসীর সাংসদ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কাশী বিশ্বনাথ করিডর’তৈরি হয়েছে। মোদির স্বপ্নের প্রকল্পের জন্য মন্দির ও একাধিক গঙ্গার ঘাটের আশপাশের চার-পাঁচশো বছরের পুরনো বাড়ি, মন্দির ভাঙা পড়েছিল। মোদী বেনারসের আসল চরিত্র বদলে দিয়েছেন। বেনারসের আসল ফ্লেভারটা হারিয়ে গেছে ভাজপার ' উন্নয়নে'। তাই অনেকেই বলছেন, এবারের নির্বাচনে খোদ নরেন্দ্র মোদীকেও গণনার প্রথম রাউন্ডে পিছিয়ে থাকতে হয়েছিল। যদিও শেষপর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী মাত্র দেড় লাখ ভোটে জিতেছেন।