ক্রমিক সংরক্ষণ নয়বংশানু, ক্রিমি লেয়ার ছাটতে হবে
৩৬৫ দিন। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে কর্মরত এক আইয়ের অফিসারের সঙ্গে কথা বলার সময় অবাক হয়ে গিয়েছিলাম জেনে যে তিনি নাকি ৮ বার ইউপিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরে আইএএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। রবার্ট ব্রুসের মতো অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিলেও তার ৮ বার পরীক্ষা দেওয়ার পিছনে একদিকে ছিল তাঁর ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বাবার চাকরি থেকে পাওয়া পর্যাপ্ত বেতন আর সর্বোপরি আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী এসসি সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় অগণিত বার ইউপিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ। অথচ পরিচিত বহু বন্ধু-বান্ধব শুধুমাত্র এসসি বা এসটি সম্প্রদায়ের ভুক্ত না হওয়ায় নির্ধারিত ৩২ বছর পেরিয়ে গেলেই হাজার অনুরোধেও নতুন করে পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান না। তবে এবারে হয়তো বদলে যেতে চলেছে চেনা এই ছবিটা। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির বিশেষ সাংবিধানিক বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায়ের পরে এমন আশাতেই বুক বাঁধছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।
কি হতে পারে নতুন এই রায়ের ফলেদিল্লির উচ্চপদস্থ যে হামলার কথা বললাম তার বাবা যেমন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সত্বেও তিনি পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরির পরীক্ষা এবং চাকরিতেও বিশেষ সংরক্ষণের সুবিধে পেয়েছেন শুধুমাত্র এসসি বা তফশিলি জাতিভুক্ত হওয়ার সুবাদে। যে সুবিধা তাঁরা পেয়ে আসছেন কয়েক পুরুষ ধরে বংশানুক্রমিক ভাবে। অথচ তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। রয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠা। রয়েছে সামাজিক পরিচিতি এবং ছোটবেলা থেকেই আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধে। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের সাম্প্রতিকতম রায়ের ফলে বদলে যেতে চলেছে বংশানুক্রমিক ভাবে এই সংরক্ষণের সুবিধা ভোগের সিস্টেমটাই। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তপশিলি জাতিভুক্ত হয়ে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় এবং বড় হওয়ার পরে চাকরির পরীক্ষা বা চাকরিতে ঢোকার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধে নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তারপরে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রথমে সিডিউল্ড কাস্ট ক্রিমি লেয়ার কোটাভুক্ত করা হবে এবং পরে যাবতীয় সংরক্ষণের সুবিধা বা কোটার তালিকা থেকে বের করে দিতে হবে। কারণ যে কারণে সংরক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেই কারণটাই সম্পূর্ণ হয়ে গেল। অর্থাৎ তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় থেকে এসে সরকারের দেওয়া সংরক্ষণের সুবিধে নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তার পরিবারের বা বংশানুক্রমিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আর এই সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় নয়। সুপ্রিম কোর্ট যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে নিয়মিত এভালুয়েশন বা পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখতে হবে কারা এখনো পিছিয়ে রয়েছেন এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন, তাদের জন্য সংরক্ষণের যাবতীয় সুবিধে দিতে হবে। অর্থাৎ ঢেলে সাজাতে হবে গোটা দেশে শুধুমাত্র এসি বা এস টি সার্টিফিকেট এর জোরে কারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্বেও দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় সংরক্ষণের যাবতীয় সুযোগ সুবিধে নিয়ে যাচ্ছেন অপ্রয়োজনীয় ভাবে। আর যাদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সরকারি সংরক্ষণের সুবিধে না পেয়ে থেকে যাচ্ছেন দারিদ্র্যের অন্ধকারে, তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে সংরক্ষণের আওতায় এবং স্বীকৃতি দিতে হবে তাদের মেধাকে। যদিও খুব একটা সহজে সুপ্রিমকোর্টের এই রায় এস সি বা এস টি সম্প্রদায় ভুক্ত সমাজের ক্রিমি লেয়ারের ব্যক্তিরা মেনে নেবেন বলে মনে হয় না।
সংরক্ষণ হোক এক প্রজন্মেরভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে যেভাবে বংশানুক্রমিকভাবে সংরক্ষণ নীতির আওতায় থাকার নীতি চালু রয়েছে তার আমল সংস্কার ঘটিয়ে রাজ্যগুলির হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া উচিত বলে রায় প্রকাশ করেন বিচারপতি পঙ্কজ মিত্তল। রাজ্যগুলিকে সমাজের মাইক্রো লেভেলে বাড়তি নজরদারি চালিয়ে প্রত্যেক নাগরিককে বিশেষ করে সংরক্ষণের সুবিধে প্রাপ্ত নাগরিকরা সুবিধা পাওয়ার পরে কতখানি উন্নয়নের শরিক হতে পারলেন তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর এভালুয়েশন করার রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি সংরক্ষণের সুবিধে পেয়ে সমাজের অশিক্ষার অন্ধকারে থাকা কোন পরিবার থেকে উঠে এসে সরকারি আমলা বা বড় সরকারি চাকরি পেয়ে যান তাহলে তার সন্তানকে আর সেই সংরক্ষণের আওতাভুক্ত রাখা হবে না। এই বিষয় বিচারপতি পঙ্কজ মিত্তল বলেন, সংরক্ষণ কেবল প্রথম প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। প্রথম প্রজন্মের কোনও সদস্য সংরক্ষণের মাধ্যমে উচ্চতর মর্যাদায় পৌঁছে গেলে দ্বিতীয় প্রজন্মের কোনও সদস্য সংরক্ষণের অধিকারী হওয়া উচিত নয়। বিচারপতি সতীশ চন্দ্র শর্মা বিচারপতি গাভাইয়ের মতামতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেন, তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের চিহ্নিত করার বিষয়টি রাজ্যের সাংবিধানিক অপরিহার্য হওয়া উচিত।