পূষন গুপ্তর কলম
শুভেন্দুবাবু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শুনবেন অনুগ্রহ করে একটি ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আগস্ট বিপ্লব'এর সঙ্গে গুলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ, জনসাধারণকে অপমান করবেন না
১. আর জি কর’এর ওই মহিলা চিকিৎসক (ঈশ্বরসদৃশ, কেননা আমি সব চিকিৎসককে ভগবানের থেকে বড় মনে করি) ডিউটির পর সেমিনার রুমে শুতে গিয়েছিলেন। তিনি উইক এন্ড পার্টি যাননি। তাঁর কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ তাঁর কাছে সবচেয়ে সুরক্ষিত আশ্রয়ে ঘুমতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে ধর্ষিত হয়ে মরে যেতে হল। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও, প্রচুর ঢক্কানিনাদের পরেও, বিশ্বের সবচেয়ে অপদার্থ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বেটি বাঁচাও' প্রকল্পের পরেও এই মুহূর্তে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেবে ভারতবর্ষে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হচ্ছেন। তাঁর বয়স ২/৩ হতে পারে, ৬৫/৭০ ও হতে পারে। ঘটে চলেছে দিল্লিতে, উত্তরপ্রদেশে, হরিয়ানায়, বেঙ্গালুরুতে, মধ্যপ্রদেশে, ভাগলপুরে, চেন্নাইতে, কোচিতে, মুম্বইতে, গোটা দেশজুড়ে। কোনওটা পুলিশে রিপোর্ট হচ্ছে, কোনওটা রিপোর্ট হচ্ছে না। লোকলজ্জার ভয়ে রিপোর্ট না হলে তা রেকর্ডেও আসছে না। এটি একটি অসভ্য ভারতবর্ষ, গরিব এবং অশিক্ষিতদের জন্যই এই দুরবস্থা বলে পাশ ফিরে ‘পেডাগগি অফ দ্য অপ্রেসড' বই খুলে বসতে পারি, নেটফ্লিক্স’এ ‘ব্ল্যাকলিস্ট' সিরিজ দেখতে পারি, একটু সচেতনতা দেখাতে হবে ভেবে একদিন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে ফ্যাব ইন্ডিয়ার কালো পাঞ্জাবি পরে ফটোশুট করতে পারি অথবা পার্সোনাল ঝাল মেটাতে স্কুল বা টিচারদের কমনরুমে একটা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে মুখ বিকৃত করে সিএম/ পিএম রিজাইন বলে পরিতৃপ্ত (অর্গাজম অর্থে) হতে পারি অথবা প্রাগের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ নিয়ে পাকাপাকিভাবে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে পারি। অথবা কিছুই করতে পারি না। মানিকবাবুর তাঁতি গল্পের মতো শুধু অভ্যেসবশত নিরর্থক সুতোহীন তাঁত টেনে যেতে পারি !
২. আমি যতই কালো ব্যাচ পরে সেলফি তুলি না কেন, ওই চিকিৎসক, মা-বাবার সন্তান আর ফিরে আসবে না। আমি টিভি চ্যানেলের (সভ্যতার সবচেয়ে কুৎসিত মাধ্যম) ক্যামেরার সামনে যতই নাটক করি না কেন, যাদবপুর হস্টেলের সেই ছেলেটি যাকে উলঙ্গ করে সিনিয়র সহপাঠীরা ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে মেরে ফেলল, সে আর ফিরে আসবে না । আমি বাড়িতে বসে থাকি বা রাজপথে নামি, বানতলায় অনীতা দেওয়ানের শরীরে ৫ সেলের টর্চ ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হবে, তাপসী মালিককে ধর্ষণের পর জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হবে, নির্ভয়ার শরীরে রড ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে দেওয়া হবে, বাংলার গ্রামে বরযাত্রীর বাস থামিয়ে ৩০ জনকে গণধর্ষণ করা হবে, নয়না সাহানীকে তাঁর স্বামী টুকরো টুকরো করে তন্দুরে ঢুকিয়ে ফ্রাই করবে। আমি চাই বা না চাই শবদেহের রাজনীতি চলবে। বিরোধীরা শাসক দলের পদত্যাগ চাইবে।
৩. আমি কৃতজ্ঞ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিসের কাছে। উনি যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, উনি যে জাতীয় টাস্কফোর্সের কথা বলেছেন তা যুগান্তকারী। এই দেশের গভীর, গভীরতর অসুখ এখন উনি চিকিৎসকদের নিয়ে অসুখের গোড়াটা উৎপাটিত করতে চাইছেন। এই মূর্খ নোংরা রাজনীতির জগৎ আর অশিক্ষিত (মোস্টলি সেকেন্ড বা থার্ড ক্লাস) মিডিয়া ওঁর প্রেসক্রিপশন বোঝেনি, আমি জানি। আমার স্যালুট ওঁকে।
৪. আমি উপরে হাসিনার ছবির পাশে যে ক্লাবটি দিয়েছি তাতেই অনেকটা বলে দেওয়া হয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করি। বাংলাদেশ সম্প্রতি যে আগস্ট বিপ্লব’এর সাফল্য পেয়েছে, তার পেছনে শেখ মুজিবের কন্যা হওয়ার দৌলতে উপমহাদেশের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কয়েক হাজার গণহত্যার পরিণতি। আমি ইচ্ছে করলে ওর সঙ্গে তুলনা সারা বিশ্বের অন্তত ১০ জন স্বৈরাচারীর নাম বলতে পারি। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়। প্রিয় পাঠক তুলনার দায়িত্ব আপনাদের।
৫. শুভেন্দুবাবু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের আমার অনুরোধ অনুগ্রহ করে বাংলাদেশের এই আগস্ট বিপ্লব'এর ইতিহাস ও ধারাবাহিকতাকে সামান্য মন দিয়ে অনুধাবন করুন। রাজনীতিতে যদি প্রকৃত সাফল্য পেতে চান, তাহলে শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কমরেড মাও’এর অর্থনীতি ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু ‘গ্রাম দিয়ে শহরে ঘেরার' থিওরি এবারের বাংলাদেশ বিপ্লবের সেরা মডেল। রংপুর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, খুলনা সর্বত্র বিপ্লবের আগুন জ্বলেছে আগে, নিরস্ত্র ছাত্রসমাজ বন্দুকের সামনে বুক খুলে দাঁড়িয়েছে আগে, মৃত্যুমিছিল পেরিয়ে তবে বিপ্লব ঢাকায় ঢুকেছে। আয়না ঘর থেকে বিরোধী নেতাদের সেডাটিভ দিয়ে অচৈতন্য করে হাতের শিরা কেটে, অর্ধমৃতকে স্পিড বোটে করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে। কার সঙ্গে কিসের তুলনা করছেন ভাই? স্বৈরাচার দেখেছেন কখনও, জানেন। জানেন ফ্যুয়েরারের আউশভিৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কাকে বলে? জানেন অ্যানেস্থেশিয়া না দিয়ে হাত বা পা গোড়া থেকে কেটে দিলে কতটা যন্ত্রণা হয়? অনুগ্রহ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাকে মিলিয়ে দিয়ে আগস্ট বিপ্লব, বাংলাদেশের মানুষকে অপমান করবেন না।
৬. অতি বেশি গণতান্ত্রিক মমতাকে পেয়ে সুযোগ নিচ্ছেন তো? সৌজন্য, ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, ব্যর্থতা আরও বাড়বে।