বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির পথে হাসিনা সরকার
৩৬৫ দিন। যত সময় গড়াচ্ছে তত গৃহযুদ্ধের দিকে এখোচ্ছে বাংলাদেশ। শনিবার সকাল থেকে একের পর এক পট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাব পাল্টা আন্দোলনকারীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি, আন্দোলনের সমর্থনে বিদ্বজনেদের রাজপথে নামা সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে চলেছে। বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, যা চলছে এবং যা হতে চলেছে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী শেখ হাসিনা। গোটা দেশ তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা, হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা না দেওয়া পর্যন্ত অচলাবস্থা কাটবে না। শনিবার হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে আওয়ামী লীগের তিন শীর্শ নেতা জাহাঙ্গীর কবীর নানক, মহবুবুল আলম হানিফ এবং এএফএম বাহাউদ্দিন নাসিমের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তারা জানিয়ে দেন ছাত্রদের ওপর হামলা এবং সব গ্রেফতার হওয়া আন্দোলনকারীদের মুক্তি না দিলে কোনও আলোচনা নয়। হাসিনা যখন আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছেন তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বিবৃতি দিয়ে ১৫৮ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটির কথা ঘোষণা করে দেয়। ছাত্র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় আর ৬ জন সমন্বয়ক আন্দোলনের মুখ হিসাবে সামনে থাকবে না। আন্দোলনের গতি পথ নির্ধারণ থেকে সরকারের সঙ্গে আলোচনা ( যদি আদৌও আলোচনায় বসা হয় ) সব বিষয় এই ১৫৮ জন সমন্বয়ক মিলিত ভাবে সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন। সূত্রের খবর, আন্দোলনকারী ছাত্র নেতারা মনে করছেন, ৬ সমন্বয়ককে নানা ভাবে হাসিনা সরকার ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে চাইছে তাই এই চক্রান্ত ব্যর্থ করতে ১৫৮ জনকে সমন্বয়কের দায়িত্বে আনা হল। হাসিনাকে কথা বলতে গেলে এই ১৫৮ জনের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। আন্দোলনের নেতৃত্ব যখন ঘর গোছাচ্ছেন তখন হাসিনা জানিয়ে দেন যে কোনও শর্তে আলোচনায় তিনি রাজি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি নিজে আলোচনায় বসবেন। গণভবনের দরজা সকলের জন্য খোলা। যে কেউ আলোচনায় বসার জন্য আসতে পারেন। সন্ধির সূচনা হিসাবে তিনি বন্দি ছাত্রদের মুক্তির নির্দেশ দেন। যদিও হাসিনার চাপের মুখে আলোচনায় বসতে চাওয়াকে ছাত্ররা খারিজ করে দেয়। সমন্বয়কদের তরফে শনিবার দুপুরে জানিয়ে দেওয়া হয় তারা হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় বসছেন ন। আগে সরকারকে সব শর্ত মানতে হবে তবেই আলোচনা। একদিকে হামলা হবে জেলে পোড়া হবে আবার অন্যদিকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হবে তা করা যাবে না। হাসিনাকে আগে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। এদিকে আন্দোলনের পরিসর ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন এতদিন ছিল শুধু ছাত্রদের-ই আন্দোলন। কিন্তু গত ৪৮ ঘন্টায় ক্রমশ এই আন্দোলনের পরিসর বাড়ছে। এখন আর শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয় আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এমনকি বিশিষ্ট জনেরা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমনকি বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত বিচারপতি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের একটা বড় অংশ এই আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নামছেন। ফলে আন্দোলন এখন আর শুধু ছাত্রদের আন্দোলন নয় আন্দোলন এখন সার্বিকভাবে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা চাইছেন হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করুন। দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হোক সেখানে সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ প্রতিনিধি পাঠাক। প্রয়োজন হলে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সরকার গঠন হোক এবং সেই সরকারের তত্ত্বাবধানে ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন যে দাবিদাওয়া রয়েছে সেগুলো সহানুভূতি সঙ্গে বিবেচনা করা হোক এবং সেগুলিকে মানা হোক তারপর সুষ্ঠুভাবে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হোক এবং নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করুক। ছাত্র বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব স্পষ্ট করে দিয়েছেন হাসিনার সঙ্গে আলোচনা হোক বা না হোক তারা আন্দোলনের রাস্তা থেকে একেবারেই সরছে না আগামী দুদিন আন্দোলন কিভাবে গতি পাবে, তার রূপরেখা ইতিমধ্যেই স্থির করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদমাধ্যমে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কোন পথে যাবে তারা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আন্দোলনের নেতারা পরিষ্কার করে দিয়েছেন সরকারের সঙ্গে আর কোনোভাবেই সহযোগিতার পথে তারা হাঁটবেন না হাসিনা সরকারকে বয়কটের পথে যাচ্ছেন তারা সরকারি কর্মীরা কাজে যাবেন না সরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে ব্যাংক এ কাজ হবে না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কোন ঠাসা করার চেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশ কার্যত গৃহযুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একদিকে হাসিনা সরকার এবং তার প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ অন্যদিকে ছাত্র বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন গোটা ছাত্রসমাজ যুবলীগ দেশের বিশিষ্টজনীদের একটা বড় অংশ সরকারি কর্মচারীদের একটা বিরাট অংশ। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি যদি আরও ঘোরালো হয় তাহলে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ আসন্ন সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেদিকে ও নজর থাকছে। অনেকে বলছেন শেখ হাসিনার সামনে এখন দুটো রাস্তায় খোলা আছে এক তাকে পদত্যাগ করতে হবে না হলে তাঁকে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। হাসিনা যে ধরনের নেত্রী তিনি এখন একতান্তে বিশ্বাস করেন স্বৈরাচারী শাসনের পক্ষপাতী তাই তিনি কোন অবস্থাতেই চাপের মুখে পদত্যাগ করবেন না বরং তিনি দ্বিতীয় পথে হাঁটতে বেশি পছন্দ করবেন অর্থাৎ গোটা দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রেও আবার হাসিনার পক্ষে কিছু সমস্যা রয়েছে কারণ গত একমাস ধরে বাংলাদেশে যে অচলাবস্থা চলছে এবং সেই অচলাবস্থার সামলাতে সরকার যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর গুলি চালিয়েছে, কার্যত গণহত্যা হয়েছে, তাতে গোটা বিশ্বের নজর রয়েছে বাংলাদেশের উপর। এখন হাসিনার পক্ষে হঠাৎ করে আবার দমন মূলক আচরণ করা বা গোলাগুলি চালানো সম্ভব নয়। তাই হাসিনা চেষ্টা করছেন কৌশলী অবস্থান নিতে। আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ইমেজ তৈরী করতে। হাসিনার সব চেয়ে বড় সমস্যা হল কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন যে এই ভাবে সার্বিক ভাবে গোটা দেশে গণ আন্দোলনে পরিণত হয়ে যাবে তা তিনি আঁচ করতে পারেননি। তিনি স্বভাববশত আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন এখন তা ব্যুমেরাং হয়ে তাকেই ক্ষমতাচ্যুত করতে এগোচ্ছে। অনেকে বলছেন প্রথম থেকেই যদি হাসিনা আলোচনার পথে হাঁটতেন আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন তা হলে এই অবস্থা হত না। প্রথম দিকে আন্দোলন তো তাঁর বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ছিলোই না, তাই হাসিনা আগ বাড়িয়ে সমস্যা তৈরী করেছেন। হাসিনা একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। সাত দিন আগে ছয় সমন্বয়ককে হাসিনা সরকারের পুলিশ আলোচনার জন্য নিয়ে গিয়ে জোর করে আটকে রাখে। এমনকি তাদের গুম খুন করে দেওয়ার হুমকি দেয়। শেষে গান পয়েন্টে মুচলেখা লিখিয়ে নিয়ে ঢাকার রাজপথে ফেলে দেওয়া দেওয়া হয়। হাসিনার এই সব পদক্ষেপ তার সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে দিয়েছে। ছাত্র সমাজ তথা গোটা বাংলাদেশ এখন আর হাসিনাকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কার্যত গোটা বাংলাদেশের একটা হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। যেভাবে নির্বাচনে কার্যত শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগ ভোট লুট করে তা গোটা বিশ্বে সমালোচিত হয়। একের পর এক বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের জেলবন্দী করে কার্যত জরুরি অবস্থা জারির মতো পরিস্থিতি তৈরি করে ভোট করিয়ে নেয়া হয় এবং হাসিনা নিজেই নিজেকে কার্যত প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে দেন। শেখ হাসিনার এই স্বৈরাচারী মনোভাব বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ মানতে পারেনি এখন যখন সুযোগ এসেছে তখন তারা ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং হাসিনার বিরুদ্ধে রাজপথে নামছে। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারা শনিবারে ও বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকে তাদের আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বলে বদনাম করেছেন জামাতের সঙ্গে তাদের যোগ আছে বলে মিথ্যা কথা বলেছেন এক প্রকার তাদের দেশদ্রোহী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। গোটা ছাত্র সমাজকে তিনি রাজাকার বলতেও পিছু পা হয়নি। ছাত্র সমাজের প্রতি একজন প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাব তাদের ভাবাবেগে আঘাত করেছে। তাই এখন কার্যত ডু অর ডাই সিচুয়েশন। ওই হাসিনা সরকার পতন হবে না হলে সরকার গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের খতম করুক। অন্যদিকে শুক্রবার রাত থেকে পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষে উত্তাল হয়েছে বাংলাদেশের একাধিক জায়গা। কোটা-বিরোধী আন্দোলনে হিংসাত্মক ঘটনায় নিহতদের স্মরণে কর্মসূচিকে ঘিরে ফের উত্তপ্ত হল রাজধানী ঢাকা-সহ বাংলাদেশের নানা এলাকা। সিলেটের হবিগঞ্জে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এক জন। খুলনায় আন্দোলনকারীরা এক জন পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে। ঢাকার উত্তরায় সারা দিন ধরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলে। তাতে এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। অভিযোগ, উত্তরায় বেসরকারি কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এ দিন বিক্ষোভ মিছিল বার করলে পুলিশের আড়ালে থাকা সরকার সমর্থক সংগঠন ছাত্র লীগের সশস্ত্র কর্মীরা হামলা করে। তাদের হাতে পিস্তল ও তরোয়াল থাকার কথাও জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। রবিবার থেকে ছাত্ররা অনির্দিষ্টকালীন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পরে বিএনপি-সহ সব বিরোধীরা তাকে সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশের রাজপথে লাখ লাখ মানুষ নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, হাসিনার উচিৎ মানুষের রায় মেনে নিয়ে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া। সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স) যৌথ বিবৃতিতে বলেন, হত্যা–নির্যাতন করে গদি রক্ষা করা যাবে না। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সারা দেশে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে।সরকারের বিরুদ্ধে গণরায় ঘোষণা করেছে। এটি উপেক্ষা করার পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই আর কালবিলম্ব না করে সরকারকে পদত্যাগ করে গণরায় মেনে নিতে হবে। বাংলদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি শনিবার অভিযোগ করেছে জামাতকে নিষিদ্ধ করার ঘটা করে ঘোষণা করা আসলে শেখ হাসিনার একটা চাল। তাদের মতে, জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবি তো বাংলাদেশে নতুন নয়। একাধিক বিরোধী দল নানা সময়ে একাধিক বার এই দাবি করে আসছে তাহলে হাসিনা কেন ছাত্র আন্দোলনের এই সময়কেই বাছলেন জামাতকে নিষিদ্ধ করার জন্য। আসলে তিনি কৌশলে জামাতের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনকে জড়িয়ে দিলেন যাতে সাধারণ ভাবে এই ধারণা তৈরী হয় আন্দোলনের রাশ এখন জঙ্গিদের হাতে। এতে তার রাজনৈতিক সুবিধা রয়েছে। তবে এই কৌশল এবার আর খাটবে না।