ভোটের শেষ লগ্নে মোদিবাবুর মত, গান্ধি সিনেমা তোলা না হলে সারা বিশ্ব গান্ধির নামও জানত না
৩৬৫ দিন। ১০ অগাস্ট ২০০৭ : দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের আন্দোলনকে বিশ্বের দরবারে পৌছে দেওয়ার পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে নিজেদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াইতে মার্টিন লুথার কিং এর পাশাপাশি থাকবে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নাম। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আমি যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম সেই আন্দোলনের প্রধান অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও দর্শন থেকে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করার পরে সেখানকার সরকার মহাত্মা গান্ধীকে জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমার মনে হয় গোটা পৃথিবীতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শান্তির দূত হিসেবে মহাত্মা গান্ধীকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের। না কোন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা অথবা মহাত্মা গান্ধীর পরিবারের কারো বক্তব্য নয়। ২০০৭ সালের ১০ অগাস্ট গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে আয়োজিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য রেখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। যে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন তৎকালীন ভারতের শাসক জোট ইউপিএ সরকারের চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী।
মার্চ ২০০০ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন নিজের প্রথম ভারত সফরে এসে প্রথমেই চলে যান দিল্লিতে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে। নজিরবিহীন ভাবে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে বসে খালি পায় সমাধিতে মালা দিয়ে ধ্যান করেন বিল ক্লিন্টন। তারপরেই ছুটে গিয়েছিলেন গুজরাটের সবরমতী আশ্রমে।
আসলে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ডিপ্লোম্যাটিক প্রটোকল তৈরি হয়ে গিয়েছিল যখনই কোন বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা ভারতে আসেন কোন সরকারি বৈঠকে রাগে তারা শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতেন মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে। কারণ গোটা বিশ্বের কাছে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার প্রথমে যে নামটি আছে তা হল মহাত্মা গান্ধীর নাম।।
২৫ মে ২০২৪ - স্বাধীনতার পর থেকে ৭৫ বছর কেটে গেলেও ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে বিশ্বের কেউ চিনত না। মহাত্মা গান্ধীর উপর কোনও চলচ্চিত্র তৈরি না হলে, তাঁকে কেউ চিনতই না। না আমরা বলছি না। বলছেন ভারতের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে। মোদির আক্ষেপ, মার্টিন লুথার কিং এবং নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বে কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। ভারতেরও উচিত ছিল মহাত্মা গান্ধীকে বিশ্ববাসীর চোখে এমনই প্রথিতযশা ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা। গোটা দুনিয়া ঘুরেই এমনটা বলছি আমি। গান্ধীজিকে আরও ফোকাসে রাখা উচিত ছিল। গান্ধীর মাধ্যমেই ভারত বিশ্বে অনেকের নজর কাড়তে পারত। আজকের বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান গান্ধীবাদী মনোভাব। ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতেন মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে। কারণ গোটা বিশ্বের কাছে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার প্রথমে যে নামটি আছে তা হল মহাত্মা গান্ধীর নাম।।
কি বলেছেন মোদিএকটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদির দাবি, মহাত্মা গান্ধী একজন বিশিষ্ট ভারতীয়। কিন্তু, বিশ্ব তাঁকে চিনতই না। স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫ বছর ভারতের রাজনীতিবিদদের কর্তব্য ছিল, বিশ্বের কাছে মহাত্মা গান্ধীর পরিচিতি তুলে ধরা। কিন্তু, তেমনটা তাঁরা করেননি। মহাত্মা গান্ধীর জীবন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন নিয়ে তৈরি একের পর এক সিনেমার কারণেই বিশ্ব তাঁকে চিনতে পেরেছে। ভাবুন স্বাধীনতা পরবর্তী পর্বে আমাদের দেশের কী দুর্দশা ছিল। মহাত্মা গান্ধীর জীবন নিয়ে যখন সিনেমা তৈরি হল, তখন বিশ্বের মানুষ তাঁর সম্পর্কে কৌতুহলী হল।
মোদি বোঝেন মার্কেটিংআসলে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে হয়তো জানা সম্ভব নয় গোটা পৃথিবীর কাছে মহাত্মা গান্ধীর কি মাহাত্ম্য! কারণ তিনি তো বোঝেন শুধু মার্কেটিং। বেনিয়ার রাজ্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি হিন্দুত্ব আর বেনিয়াগিরি ছাড়া অর্থাৎ সব বেঁচে দেওয়ার রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু তো জীবনে সেই ভাবে করেননি। তাই যেখান থেকে টাকা-পয়সা আসবে না সেই বিষয় নিয়ে খুব একটা পড়াশোনা বা খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না তিনি। এবং তা নিয়ে স্বীকার করতেও কিন্তু বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। যেমন মহাত্মা গান্ধী কে কেন্দ্র করে সিনেমা তৈরি হওয়ার পরে সেই সিনেমা কত কোটি টাকায় তৈরি হয়েছে বা কত টাকার ব্যবসা করেছে সেগুলো তিনি খোঁজ খবর রাখলেও তার আগে মহাত্মা গান্ধীকে নিজেদের আদর্শ বা অনুপ্রেরণা হিসেবে মেনে নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে মার্গারেট থ্যাচারের মতো বিশ্ব রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বরা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে বা মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতির সামনে মাথা নত করলেও সেই খবর তার কাছে ছিল না। মোদি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন সেই কথা। নরেন্দ্র মোদী এবারের ভোটের আগে যেভাবে রামচন্দ্র কে নিয়ে এবং রাম মন্দির উদ্বোধন নিয়ে মার্কেটিং করেছেন সেই কথা উল্লেখ করে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে মার্কেটিং হয়নি বলে ভীষণ আফসোস প্রকাশ করে মোদির বক্তব্য, নিজেদের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়তে হবে আমাদের। আমাদের এই ৫০০ বছরের রাম মন্দির আন্দোলনকে বিশ্বের কাছে ব্র্যান্ড করতে হয়েছে। সেটা কি আমাদের মার্কেটিং করা উচিত নয়? আর এর আগে বিরোধীরা মন্দিরে যেত নির্বাচনের সময়। তবে এর উন্নয়ন করত না।
মোদির বাকি রয়েছে গান্ধী ফ্যাশনযখন যে রাজ্যের ভোট আসে তখন সেই রাজ্যের মনীষী অথবা সেখানকার আদিবাসীদের সাজে সেজে নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে ফ্যাশন প্যারেড করতে গত কয়েক বছরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাকি রয়ে গেছে মহাত্মা গান্ধীর ফ্যাশন। যদিও তার পিছনে একটা শুদ্ধ কারণ রয়েছে। তাহলে ২০১৯ সালের পর থেকে নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ করে নিজেকে বিশ্ব গুরু বলে প্রচার করতে শুরু করেছেন। তার কথাই নাকি থেমে যায় চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তাইওয়ান নিয়ে দীর্ঘকালের যুদ্ধ সম্ভাবনা। মোদির একটা ফোনেই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত হন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন থেকে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এমনকি বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত এমন দাবি করতে শুরু করেছেন পরবর্তী বিশ্ব শান্তি পুরস্কারে বা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত নরেন্দ্র মোদির। তাই হয়তো মহাত্মা গান্ধীকে প্রধান প্রতিপক্ষ ভেবে তাতে খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ মোদী।
তীব্র নিন্দা তৃণমূলেরতৃণমূলের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করা হয়। যেখানে নরেন্দ্র মোদীকে ট্যাগ করে লেখা হয়েছে, কেউ চেনে না মহাত্মা গান্ধীকে? এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। নরেন্দ্র মোদী এবার মহাত্মা গান্ধীর উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে মহান ব্যক্তিত্ব দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং গোটা দুনিয়ায় সর্বজন শ্রদ্ধেয়, তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মোদীজি জেনে রাখুন, মহাত্মা গান্ধী দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে থাকেন।