৩৬৫ দিন। বাংলার বিধানসভায় সর্বসম্মতক্রমে পাস হয়ে গেল ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহ বিরোধী অপরাজিতা বিল। গত ২৮ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন বাংলার বিধানসভায় এই বিল আনা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মত রাজ্যের আইন মন্ত্রী মলয় ঘটক আজ রাজ্য বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে অপরাজিতা বিল পেশ করার পরে তার কোন বিরোধিতা না করে বিল পাসে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি। এই বিলে ধর্ষণ করে খুনের মতো ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের নিদান রয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা রয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রেই জরিমানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দ্রুত বিচার পর্ব শেষ করা ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তিই এই বিলের লক্ষ্য। বিলের নাম রাখা হয়েছে, অপরাজিতা উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড (ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২৪।
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধিবাংলার বিধানসভায় আনা অপরাজিতা মহিলা এবং শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধনী) বিল ২০২৪ সম্পর্কে বলতে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই বলেন, ধর্ষণ জাতীয় লজ্জা। ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। আসুন আমরা সবাই মিলে একজোট হয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই করি। ধর্ষণ রোখার ক্ষেত্রে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, মানুষের জাগরণের প্রয়োজন রয়েছে। অনেক সংস্কার হয়েছে এই বাংলায়। আমি প্রধানমন্ত্রী কাছে দুটি চিঠি পাঠিয়ে কঠোর আইন প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সংসদে সেই আইন আনার কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় আমরাই বিধানসভায় ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধিকে দূর করার জন্য কঠোর অপরাজিতা আইন আনলাম। সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনা হয়েছে এই বিলে। আদালতের অনুমতি ছাড়া যাতে মহিলা বা শিশুর পরিচয় সামনে না আসে, সেটাও বলা আছে বিলে। এই ক্ষেত্রেও আমরা ৩ থেকে ৫ বছরের সাজার প্রস্তাব রাখছি।আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে মমতা বলেন, ধর্ষণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আমরা চাই ধর্ষণের ক্ষেত্রে দ্রুত পুলিসি অনুসন্ধান করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। তাই নতুন আইন আনা হচ্ছে। মেয়েদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ৩ সেপ্টেম্বর একটা ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮১ সালে এই দিনে মেয়েদের অধিকার সুরক্ষার জন্য ইউনাইটেড নেশন চালু করেছিল নারী বৈষম্য বিরোধী কমিটি। এই দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্য আমি ইউএনকে ধন্যবাদ জানাই।
শুভেন্দুর শর্তাধীন সমর্থনএকুশের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি বাংলার বিধানসভায় প্রধান বিরোধীদল হওয়ার পর থেকে এই প্রথম সরকারপক্ষের আনা কোন বিলে পূর্ণ সমর্থন জানালো বিরোধী বিধায়করা। আজ অপরাজিতা বিল সম্পর্কে আলোচনার সময় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, এই বিলটি অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলছি। আমরা রেজাল্ট চাইছি। আমরা সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি, কোনও ভোটাভুটি চাইব না। কিন্তু এই বিল অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। এই বিল কার্যকর করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি শুভেন্দু সহ ভাজপা বিধায়করা দাবি তোলেন দফা এক দাবি এক মমতার পদত্যাগ।
রাজ্যপালকে বলুন বিলে সই করতেশুভেন্দু অধিকারী এবং ভাজপা বিধায়করা অবিলম্বে এই বিলকে আইনে পরিণত করার শর্ত দিয়ে বিল পাসের সমর্থন জানানোর প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দলনেতা বললেন, বিলটা আইন হিসেবে কার্যকর করতে হবে। রাজ্যপালকে বলুন বিলটা সই করে দিতে। তারপর যদি কার্যকর না হয়, সেটা আমরা দেখব। আপনারা বলছে, সরকার ফাস্টট্র্যাক কোর্ট করেনি। আপনার কথা উত্তরে এটুকু বলার অধিকার আছে, দেশের মধ্যে ছোটরাজ্য মিলিয়ে আমরা তৃতীয়, যা লোকসভার রেকর্ডে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি মমতারভাজপার পক্ষ থেকে তাঁর পদত্যাগের স্লোগান ওঠায় মমতা বলেন, কেউ কেউ বলছে, আমরা আইন করতে পারি না। এটা সর্বৈব মিথ্যা। রাজ্য চাইলে আইন আনতেই পারে। সংবিধান সেই অধিকার আমাদের দিয়েছে। অন্ধ্র এনেছে। মহারাষ্ট্রে আনছে। আমাদের এখানে এই আইন রাজ্যপালের কাছে পাঠাচ্ছি। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। আমরা প্রথম থেকে ফাঁসি চেয়েছি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা সব ঘটনারই তীব্র নিন্দা করছি ও ধিক্কার জানাচ্ছি। কিন্তু, মোদি এবং অমিত শাহ মিলে দেশের নারীদের সম্মান ও সুরক্ষায় কিছুই করতে পারেননি। তাই আমরা নরেন্দ্র মোদির পদত্যাগ চাই, আমরা অমিত শাহের পদত্যাগ চাই। নরেন্দ্র মোদি দেশের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয় লজ্জা। ওনার পদত্যাগ চাই। আমাকে কটু কথা বললে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। আপনারা যা বলছেন বলুন। কিন্তু বাংলা মা-কে বদনাম করবেন না। আপনারা আমাকে যা যা বলছেন, তা যদি আমার দলের লোকেরা প্রধানমন্ত্রী আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, তা হলে কেমন লাগবে?
আরজিকরের নির্যাতিতা প্রসঙ্গেআরজি করের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মমতা বলেন, মেয়েটি মারা গিয়েছে ৯ অগাস্ট। ১২ তারিখ নির্যাতিতার বাড়িতে যাই। তার আগে ঘটনার তদন্তকারী অফিসারকে নথিপত্র নিয়ে নির্যাতিতার বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। যাতে গোটা তদন্তের বিষয়টি পরিবার জানতে পারে। সোমবার আমি গিয়েছিলাম। বলেছিলাম রবিবার পর্যন্ত সময় দিন। তদন্তে কোনও অগ্রগতি না হলে সোমবার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেব। তদন্তের জন্য ১৬৪ জনের সাইবার ক্রাইম টিম তৈরি করা হয়েছিল। পুলিসকে বলেছিলাম ফাস্টট্রাক কোর্টে যেতে। মঙ্গলবার সিবিআই হয়ে যায়। আমরাও এখন বলছি, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। প্রথম থেকেই আমরা এই ঘটনায় ফাঁসি চেয়েছি। গভর্নর বিলে সই করে দিলে তা আইনে পরিণত হবে।
কি রয়েছে অপরাজিতা বিলেধর্ষণের মামলার আরও দ্রুত বিচার এবং কঠিন সাজার বন্দোবস্তের জন্য নতুন যে সংশোধনী বিল আজ রাজ্য বিধানসভায় অপরাজিতা মহিলা এবং শিশু (পশ্চিমবঙ্গ অপরাধ আইন সংশোধনী) বিল ২০২৪ পাস হয়েছে, এই বিল পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে রাজ্যে ধর্ষণের সাজা হবে জরিমানা-সহ যাবজ্জীবন কারাবাস, নয়তো মৃত্যু। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আনা নতুন সংশোধনী বিলে রয়েছে, ধর্ষণের সাজা জরিমানা-সহ আমৃত্যু সাজা। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের সাজাও। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ ধারায় ধর্ষণের সাজা জরিমানা-সহ অন্তত ১০ বছর কারাদণ্ড, যা যাবজ্জীবনও হতে পারে। সরকার নির্যাতিতার হয়ে মামলা লড়ার সাত বছর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষ কৌঁসুলি (স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর) নিয়োগ করবে। এছাড়া ৪৬ ধারার ৩বি উপধারায় জেলা স্তরে অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সংশোধনী বিলে। যার প্রধান হবেন ডেপুটি পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক। বিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ধর্ষণের মামলার তদন্ত করবেন মহিলা অফিসারেরা। তদন্তে ইচ্ছাকৃত ভাবে দেরি করাতে চাইলে তাঁরও শাস্তি জরিমানা পাঁচ হাজার টাকা সহ ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড পর্যন্ত হবে। পাশাপাশি, থানার ওসিকে এফআইআর দায়েরের ২১ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তার মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে। তবে তার বেশি নয়। ওসি না পারলে এসপি পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ১৫ দিনের সময় দেওয়া হবে তদন্তের জন্য। বিলে আরও প্রস্তাব আনা হয়েছে, চার্জশিট জমা দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিশেষ আদালতে শেষ করতে হবে বিচার