৩৬৫ দিন। আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। তারপর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনাকে নিয়ে ন্যক্কারজনক রাজনীতি। যার মূলে রয়েছে একের পর এক ফেক নিউজ। যা ছড়ানো হচ্ছে ফেসবুক টুইটার এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। ঘটনাটা যতটা ভয়ংকর তার থেকেও বেশি মারাত্নক ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের জমাট বুনন। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিঃসন্দেহে রয়েছে এক নৃশংস ধর্ষণ-খুন, যা নিয়ে এখন জল্পনা, ভুয়ো প্রতিবেদন এবং অতিরঞ্জিত তথ্যের বন্যা। ফেক নিউজ এর ছড়াছড়ি এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সুপ্রিম কোর্টে দেশের প্রধান বিচারপতির সামনেও পর্যন্ত এক আইনজীবী সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজবকে আইনি যুক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করতেও বিরত হননি। বাধ্য হয়েই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় আদালতের যুক্তির জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও ব্যবহার করার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে এও বলা হয়, নির্যাতিতার পেলভিক হাড়, গলার হাড়-ভাঙা সহ বিভিন্ন বহু জায়গায় আঘাতের কথা বলা হয়। পরবর্তীতে কলকাতার গোয়েন্দা প্রধান বলেন, কোনও হাড় ভাঙা ছিল না।
মূল যে গুজব গুলি আরজিকরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষ মূল ধর্ষণ বা হত্যার ঘটনা থেকেও এই সমস্ত গুজবে যেভাবে বিশ্বাস করে চলেছেন, তার প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টে জমা পরা সিবিআই রিপোর্ট, কলকাতা হাইকোর্টে জমা পড়া তদন্তকারীদের রিপোর্ট থেকে উঠে এসেছে বেশ কিছু প্রকৃত তথ্য।
আত্মহত্যার দাবিপ্রচার করা হয়েছিল কলকাতা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক নাকি মৃতার বাবা-মাকে ফোন করে বলেছিলেন তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই প্রচার যে সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা ফাঁস হয়ে গিয়েছে মৃতার বাবা-মায়ের বয়ানে। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন আরজিকর হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার পরিচয়ে দিয়ে কেউ একজন তাদের ফোন করে জানিয়েছিলেন, খুব সম্ভবত আপনাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
পুলিশ নাকি দেহ দাহ করেছেভাজ্পানি তা শুভেন্দু অধিকারী থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা মোঃ সেলিম পর্যন্ত প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন কলকাতা পুলিশ নাকি মৃতার বাবা-মায়ের হাতে নিহত ডাক্তারের মৃতদেহ তুলে না দিয়ে নিজেরা শ্মশানে নিয়ে দাহ করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গিয়েছে এবং মেতার পরিবার হাইকোর্টে যে মামলা দায়ের করেছিলেন তার নথিতে দেখা গিয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে পোস্টমর্টেম এর পরে মৃতার দেহ তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তার পরিবার পরিজনরাই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে নিহত ডাক্তারের দেহদাহ করেন।
১৫১ গ্রাম বীর্যের গুজবসবচেয়ে বিরক্তিকর কিন্তু বিভ্রান্তিকর দাবি, ধর্ষণকে গণধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা। ডাক্তারের ধর্ষণ-হত্যার পর প্রাথমিক দাবি ছিল গণধর্ষণের। যা সিবিআই এর প্রাথমিক তদন্তের পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই ভুল তথ্য এল কোথা থেকে? এক ডাক্তারের সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে। এক ডাক্তার বলেন, তিনি ওই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পড়েছেন যেখানে ১৫১ গ্রাম চটচটে তরল পদার্থ নির্যাতিতার যোনি থেকে পাওয়া গিয়েছে। যা একজনের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই এত পরিমাণ বীর্য পাওয়া গেলে তা কেবল সঞ্জয় রায়ের কাজ নয়। আরও অনেকে যুক্ত থাকার কথা। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সামনে এক আইনজীবী এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন আমার সামনে পোস্টমর্টেম এবং অটোপসি রিপোর্ট রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া দেখে ভুলভাল গুজব ছড়াবেন না।
প্রকৃত ধর্ষক নাকি তৃণমূল বিধায়কের ছেলেসিপিএম এবং ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল আরজিকরের ঘটনায় সঞ্জয় রায় গ্রেফতার হলেও নাকি মূল ধর্ষক তৃণমূল বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রের ছেলে। সে নাকি ঘটনার পর থেকে পলাতক। সৌমেন মহাপাত্র তার ছেলেকে প্রকাশ্যে এনে সংবাদ মাধ্যমের সামনে জানিয়ে দেন তার ছেলে আরজি করের ছাত্র নয় এবং সে অন্যত্র সরকারি চাকরিতে কর্মরত। গুজব ছড়ালে মানহানির মামলা করার হুঁশিয়ারি দেওয়া মাত্র থেমে যায় সেই গুজব।
নিহত ডাক্তারের শেষ মুহূর্তের ভুয়ো ভাইরাল ভিডিওআরজিকরের চিকিৎসক পড়ুয়া নাকি মারা যাওয়ার আগে নিজের মাকে ভিডিও কল করে দেখিয়েছিলেন তাকে কিভাবে মারাত্মক আহত করে গলা কেটে দেওয়া হয়েছে। এমন দাবি করে একটি ভিডিও ভাইরাল করা হয় ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে কলকাতার এক মেকআপ আর্টিস্ট মহিলা নিজের মেকআপের কারিগরি দেখানোর জন্য এমন ভিডিও বানিয়েছেন রক্তাক্ত সেজে।
বিরাট কোহলির ভুয়ো ভাইরাল ভিডিও২০১৬ সালে বেঙ্গালুরুর এক মহিলাকে যৌন হেনস্থার ঘটনার প্রেক্ষিতে বিরাট কোহলি তীব্র নিন্দা করে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সেই ভিডিওকে কাটছাট করে আরজিকরের ঘটনায় মমতার সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা জনক প্রতিক্রিয়া বলে ভাইরাল করা হয়েছিল। যা নিশ্চিত করেছেন বিরাট কোহলি নিজেও।
ধৃত সঞ্জয় রায় নাকি বিহারের বাসিন্দাআরজিকরের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল ১২ ঘণ্টার মধ্যেই। এরপর থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার শুরু হয় বিহারের বাসিন্দা সঞ্জয় রায়কে রাজ্য সরকার সিভিক ভলেন্টিয়ার এর চাকরি দিয়েছে এবং সে ধর্ষণ করেছে। কলকাতা পুলিশ তদন্তের পরে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে সঞ্জয় রায় আজন্ম কলকাতার বাসিন্দা।
রাত দখলের রাতে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগস্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে মহিলাদের রাত দখলের যে প্রতিবাদ আন্দোলন ছিল সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নাকি পূর্ব বর্ধমানের একটি মেয়ে অঙ্কিত বাউড়ি গণধর্ষিতা হন এবং তারপরে তাকে খুন করা হয় বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল প্রচার শুরু হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে পূর্ব বর্ধমানে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।