রিপোর্ট : সৌগত মন্ডল, ছবি – অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দেশখালি
২২ দিনের মধ্যে ১৩ আবেদন। না কেন্দ্রীয় আবাস যোজনা প্রকল্পে বাড়ি করার জন্য আবেদন পত্র নয়। সন্দেশখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের গত ২২ দিনের মধ্যে ১৩ টা আবেদন পত্র জমা পড়েছে হোমস্টে খোলার জন্য। যেভাবে গত মাস দুয়েক ধরে সন্দেশখালিতে দেশের বিভিন্ন জায়গার রাজনৈতিক পর্যটকেরা ছুটে আসছেন তার ফলে এতকাল রাতে থাকার হোটেল ছাড়াই কাটিয়ে দিলেও সন্দেশখালিতে হঠাৎ করে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে পর্যটকদের থাকার জায়গা। শুধুমাত্র সগর্ভে মাথা তুলে রয়েছে পিডব্লুডি-র সুদৃশ্য বাংলো।
লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার পরে গত কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত হয়ে থাকা সন্দেশখালি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা যেমন গরম গরম ভাষণ দিচ্ছেন তা শুনে ভেবেছিলাম বোধহয় পা রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে।
কিন্তু কোথায় কি? কলকাতা থেকে বাসন্তী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে প্রথমে সরবেড়িয়া এবং পরে ধামাখালিতে গাড়ি রাখার সময় মনে হচ্ছিল এতক্ষণ কিছু দেখতে না পেলেও ধামাখালি থেকে খেয়া নৌকো বেরিয়ে সন্দেশখালি দ্বীপে পা রাখলেই রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যাব হয়তো! কিন্তু ধামাখালি ঘাট থেকে তিন টাকার টিকিট কেটে সন্দেশখালিতে পা রাখার পরেও বেশ অবাক হলাম। আগেও সন্দেশখালিতে এসেছি। কিন্তু এবারে এলাম দীর্ঘদিন পরে।
মনে পড়ে গেল, 2006 সালের বিধানসভা ভোটের সময় এখানেই পুলিশকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটাতে হয়েছিল ব্যালট বাক্স নিয়ে দৌড় মারা সিপিএম-এর কমরেডদের আটকাতে!
বাম জমানায় নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন এবং সেখানে পুলিশের গুলি চালনা থেকে শুরু করে নেতাই গণহত্যা বা লালগড়ে কিষেনজি-র নেতৃত্বে মাওবাদী সন্ত্রাস দেখেছি। দিনের পর দিন সেখানে থেকে নিউজ কভার করেছি। এমনকি সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনও দেখেছি। কিন্তু তার ধারে কাছে কোথাও রাখতে পারব না সন্দেশখালীর নাম। কৌলিন্য বলে তো একটা কথা আছে। তা সে কুলীন ব্রাহ্মণ হোক আর সন্ত্রাসের কৌলিন্য! যাই হোক না কেন।
এতটা শান্ত এবং বাজার ঘাট এবং দোকানপত্র দেখে নিজেরই কিছুটা সন্দেহ হলো সন্দেশখালিতে এলাম তো নাকি অন্য কোন দ্বীপে চলে এলাম ভুল খেয়াতে চেপে! তাই খেয়া ঘাটে টিকিট কাউন্টারে বসে থাকা রঞ্জিত মন্ডলকে জিজ্ঞেস করলাম দাদা এটাই সন্দেশখালি তো? আচমকা বেলা ১১ টার সময় আমার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলেও মুচকি হেসে তিনি বললেন, হ্যাঁ দাদা ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। সাংবাদিক নাকি? মাথা নাড়তেই কিছুটা যেন ব্যঙ্গ হেসে বললেন, দেখুন কী গল্প খুঁজে পান। রোজ কতজন আসছেন! সুন্দরবন ঘুরতেও সিজনের সময় এত লোক আসে না।
মিলল না দেশি মুরগিও
এমনিতেই সারা বছর সন্দেশখালিতে লোকজন আসে কম। এবারে সম্পাদক সন্দেশখালিতে পাঠানোর অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার পর থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম সন্দেশখালিতে গিয়ে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজনটা বেশি মুরগির কষা মাংস দিয়ে বেশ জমিয়ে করব। কিন্তু সে গুড়ে বালি! সন্দেশখালীর বিখ্যাত টোটোতে চড়ে বেশ কয়েকটা পাড়া খুঁজেও একটাও দেশি মুরগি পেলাম না। সকলের বক্তব্য এত সাংবাদিক আর পুলিশ আসছে আর পার্টি বাবুরা আসছেন দেশি মুরগি আর কোথাও পাবেন না। তবে গ্রামের মহিলারা পাশের খালে মাছ ধরছেন দেখে জল জ্যান্ত কয়েকটা ভেটকি মাজার পার্সে মাছ পেলাম।
সন্দেশখালি জুড়ে যে সন্ত্রাসের পরিবেশের কথা শুনে আসছিলাম সেগুলো তাহলে কোথায় গেল? খোঁজ করতে চলে গিয়েছিলাম সন্দেশখালীর পুরনো থানা এলাকার পুকুরপাড়ায়। সেখানে গিয়ে শেখ শাহজাহানের প্রসঙ্গ তুলতেই কার্যত পাত্তাই দিলেন না গ্রামের বাসিন্দারা। পূজা মন্ডপে বসে থাকা সৈকত দাস, গৌতম পরামান্য, সন্ন্যাসী সরকারের মতো এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিরা বরং
কিছুটা জোর করেই আমাদের দেখাতে নিয়ে গেলেন উত্তম কুমার অমানুষ ছবির শুটিং করতে এসে কোন জায়গায় ছিলেন আর কোন কালী মন্দিরে পূজো দিয়েছিলেন। সেই কালী মন্দিরে আজ রীতিমতো ডিজে বাজিয়ে বড়সড়ো পূজোর আয়োজন হয়েছে। সন্দেশখালি প্রাথমিক স্কুলের মাঠেই গ্রামের মহিলারা বঁটি কড়াই নিয়ে এসে সকাল থেকে লেগে গিয়েছেন খিচুড়ি আর বাঁধাকপি চচ্চড়ির আয়োজন করতে। আমাদেরও নিমন্ত্রণ করলেন অবশ্য খাওয়ার জন্য। কয়েকজন মহিলাকে দেখলাম তারা চলেছেন পূজোর জন্য বাকি বাজার ঘাট করতে খেয়া ঘাটের কাছে। আমাদের কাছে শুধু বারে বারে অনুরোধ করলেন একটু ভালো করে লিখুন তো আমাদের এখানে অমানুষ ছবির শুটিং হয়েছে, উত্তম কুমার এসেছেন – এগুলো জানলে যদি বাইরে থেকে কিছু লোকজন বেড়াতে আসে।
রোজা রেখেও বাজার ঘাটে মুসলিম মহিলারা
একে রোজার সময়। তার উপরে গ্রীষ্মকাল। ভেবেছিলাম গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে হয়তো খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ করে কথা বলতে পারব না। কিন্তু সন্দেশখালীর ছবি দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে আবার খেলা পেরিয়ে এসে শেখ শাহজাহানের বাড়ি যে আকুঞ্জি পাড়া এলাকায় সেখানে দেয়ালে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় শাহজাহানের নামে প্রচারের ছবি তুলতে পাড়ায় ঢুকতেই দোকানে যাওয়ার পথে কয়েকজন মুসলিম মহিলা এগিয়ে এলেন আমাদের পরিচয় জানতে। মাফুজা নামে এক ভদ্র মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন আপনারাও কি সাংবাদিক? রোজ কত সাংবাদিক দেখতে পাচ্ছি। ঠিক করে বলুন তো শাহজাহান ভাই ঠিক কি করেছে? শাহজাহানের বিরুদ্ধে মহিলাদের উপরে অত্যাচার সহ যে সমস্ত অভিযোগের কথা উঠে এসেছে তার দু একটা বলতে যেতেই মুচকি হেসে তারা বললেন, আমাদের গ্রামে বা আশেপাশে তো কোথাও কোন মহিলার উপরে অত্যাচার হয়েছে বলে কখনো শুনিনি।