৩৬৫ দিন। বাঙালির উন্নতির কোনও চেষ্টা নেই, দৌড় সেই মৃণাল সেনের ছবি পর্যন্তই। বড়জোর একটু মদ্যপান সহযোগে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আঁতেল সাজার চেষ্টা , সিটি অফ জয়- এভাবেই বাংলা এবং বাঙালিকে অপমান করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সঞ্জীব স্যানাল। বাঙালি হয়েও এমন কদর্য ভাষায় বাঙালিকে অপমান করায়, গর্জে উঠেছে বাংলার শিক্ষিত ও মননশীল সমাজ।
আধা বাঙালি সঞ্জীবের বাঙালি বিদ্বেষ
সিদ্ধার্থ আহলুওয়ালির ‘দ্য নিওন শো’ অনলাইন পডকাস্ট শোতে কলকাতা এবং বঙ্গ সমাজকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন সঞ্জীব স্যান্যাল। সেখানেই তিনি, বর্তমান বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কলকাতার যে দুর্দশা হয়েছে তার জন্য দায়ী এখানকার সাধারণ মানুষ। কলকাতার একটা বিশাল অংশের মানুষ সিগারেট, মদ পান করে দিন অতিবাহিত করেন, কিন্তু দিনের শেষে সঠিক লক্ষমাত্রা পূরণে ‘দৈন্যতা’ লক্ষ্য করা যায়। বড়জোর মৃণাল সেন অবধি গিয়ে আটকে গিয়েছে। ঘরোয়া আড্ডায় মদ্যপান আর সিগারেট ফুঁকে নিজেকে বুদ্ধিজীবী বা আঁতেল ভাবে।
বাংলা অক্ষরজ্ঞান নেই,ধান্দাবাজ
বললেন জহর সরকার
এই মেকি বাঙালি সঞ্জীবের আসল চেহারা সামনে এনেছেন জহর সরকার,তিনি বলেন,প্রধানমন্ত্রীর এই বাঙালি আমলাকে আমি চিনি। সারা জীবন দিল্লি আর বিদেশে কাটিয়েছেন। বাংলা অক্ষরজ্ঞানটুকুও নেই। ধান্দাবাজ এবং বিশ্বাসঘাতক, তাই তীব্র বাঙালি বিদ্ধেষী। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই নরেন্দ্র মোদীকে বাংলা বিরোধী পরিকল্পনা দিয়ে চলেছেন। বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এই এই কুৎসিত ব্যাখ্যা সেই পরিকল্পনার অংশ ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ আমলা জহর সরকার প্রধানমন্ত্রীর এই ‘বাঙালি’ অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকে ভালো করে চেনেন। সঞ্জীব সারা জীবন দিল্লি আর বিদেশেই থেকেছে। বাংলা অক্ষরও জানে না। প্রাক্তন আইএএস জহর সরকার কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রধান সচিবের দায়িত্ব সামলেছেন। একই সঙ্গে প্রসার ভারতীয়র সিইও ছিলেন এই শিক্ষিত আমলা। জহরবাবু নিজে বাংলার লোক সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন,একাধিক বইও লিখেছেন। তিনি বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞাত। তাই তিনি এই আধা বাঙালি আমলা সঞ্জীবের হওয়ায় কথা বলা ধরে ফেলেছেন। তিনি
আরও বলেন, এর মতন কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঙালিরা বিজেপি আর মোদীর ব্যক্তিগত বঙ্গ বিরোধী বিষ আর আক্রোশকে উস্কে দিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। সত্যই মৃণাল সেন পর্যন্ত দৌড় এই আধা বাঙালির। উনি হয়ত জানেন না,মৃণালের পরেও গোটা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি চলচ্চিত্র শাসন করেছে বাঙালিরাই।
বাঙালিকে আক্রমণ, ক্ষমা চাওয়া উচিত এই মীরজাফরের
প্রতিবাদ তৃণমূলের
সঞ্জীব স্যানালের বাঙালিকে আক্রমণের প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস গর্জে উঠেছে। তারা পরিষ্কার জানিয়েছে, বাংলা এবং বাঙালিকে এই সংস্কৃতিক অপমান কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলা-বিরোধী ভাজপার বাংলার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তথা আজকের যুগের মীরজাফরদের তালিকার নব্য সংযোজন সঞ্জীব সান্যাল প্রকাশ্যে বাংলার গৌরবময় সংস্কৃতির সমালোচনা করে আমাদের মধ্যে “আকাঙ্ক্ষার অভাব” আছে বলে অভিযোগ তুলে আদতে নিজেকেই বোকা বানিয়েছেন।
বিজেপির বাংলা-বিরোধী শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব মৃণাল সেন, সর্বপরি আমাদের ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করেছেন।
এই নির্লজ্জ আচরণের জন্য তাঁর লজ্জা হওয়া উচিত এবং বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
গেরুয়া বন্দনায় সঞ্জীব
বাংলা বিদ্বেষী থিওরি
এই সঞ্জীব স্যানাল নামক অর্থনৈতিক আমলাটি আসলে তীব্র নেহেরু বিদ্ধেষী হিসাবে নাম ফাটিয়েছিল। ইনি অর্থনীতির ছাত্র হলেও নিজেকে পপুলার হিস্টোরিয়ান বলে দাবি করেন। যদিও ইতিহাসবিদরা এই পপ হিস্ট্রি বা পপুলার হিস্ট্রি বিষয়টাকে কোনও গুরুত্বই দেয় না,অনেকটা তুলনামূলক সাহিত্যের মত আর কি। ইতিহাসের ওপর ওপর ঘুরে এরা নাকি ন্যারেটিভ তৈরি করে,হাস্যকর ব্যাপার স্যাপার। যাই হোক, এই ভদ্রলোক অর্থনীতি কম ইতিহাস বেশি এই ব্যালেন্সে ২০১১ থেকে নিজের টার্গেট ঠিক করে নেয়। ২০১৪ তে মোদী এলেন ক্ষমতায়।তখন ইনি একটা বই লিখে ফেললেন। দ্যা ইন্ডিয়ান রেনেসাঁ, রাইজ আফটার থাউজ্যান্ড ইয়ারস অফ ডিক্লাইন। সোজা কথায় বলতে গেলে মোদীর হাত ধরে ভারতের নতুন রেনেসাঁর সূচনা। ১০০০ বছর পর আবার সনাতন ভারতের উত্থান। এর পরেই তার দ্বিতীয় বই,ল্যান্ড অফ সেভেন রিভার্স। সেই একই থিওরি। সনাতন ভারতের ঐতিহ্য।
ফলে চট করে গেরুয়াদের থিঙ্ক ট্যাংকের নজরে পড়ে যায়। ২০১৭ থেকে মোদীর টিমে যোগদান। একই সাথে আর এক ভাজপা রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্তর হাত ধরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটারাল ফেস্টিভ্যালের প্রধান উদ্যোক্তা। ফলে থিওরিগত ভাবেই সঞ্জীব বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থাকলে বলতেন, কান ধরে দাড়িয়ে থাকো তো ছোকরা
এই বাচাল আমলাটির বক্তব্য সম্পর্কে কিছু বলার আগে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে নেওয়া ভাল। প্রবাদপ্রতিম শিক্ষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় জাতি,ভাষা আলোচনা চক্রে বলেছিলেন, বাঙালি মেধা নিয়েই জন্মায়। জীবনে যেটুকু সে গ্রহণ করে সেটা কেবল নিজেকে পরিপুষ্ট করার বিদ্যার্জন মাত্র। তাঁর ইন্দো এরিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ বক্তৃতায় তিনি বলেন, ভারতের একটাই ভাষা নয়, তাই ভারত একক নেশন নয়, শতফুলে বিকশিত শত ভাষার দেশ, সেখানে এক ভাষার উগ্র জাতীয়তাবাদ এনে চাপিয়ে দিলে চলবে না। আগে ভাষাটা জানো,তারপর সংস্কৃতি বুঝতে অসুবিধা হবে না। আজকের দিনে এই মহাপন্দিত গুরুমশাই থাকলে, আধা বাঙালি আমলা সঞ্জীবকে নির্ঘাত বলতেন, কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ত ছোকরা। দ্বিতীয় গল্পটিও আকর্ষক।
ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে ক্লাস নিচ্ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। এক বাঙালি যুবক বাংলার সংস্কৃতি, আধুনিকতা কিভাবে থমকে গিয়েছে তা নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিচ্ছিল। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বললেন, বাংলা লিখতে পারো? যুবক উত্তর দেয়, নট অ্যাট অল স্যার। সুরেন্দ্রনাথ বললেন, ওহে বাচাল বালক তুমি তো হাফ বাঙালি,আগে বাংলা ভাষা গড়গড়িয়ে বলতে,পড়তে লিখতে শেখো, তারপর বাঙালি নিয়ে বক্তিমে দিও।
ঘটনাটা যদিও ১৩৭ বছর আগে, তবুও এমন “অর্ধেক ‘’ বাঙালি আজও রয়ে গিয়েছে। এই আধা বাঙালিরাই আসলে বাংলার মূল শত্রু। রবীন্দ্রনাথ থেকে নিরোধ চৌধুরী কে না বলে গিয়েছেন এই বাচাল অর্ধ বাঙালি সম্পর্কে। এই যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্লু আইড বয় সঞ্জীব স্যানাল। ডয়েশ ব্যাংকে কাজ করা, দিল্লিবাসী এই অর্ধ বাঙালি বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। কলকাতায় জন্ম হলেও এক বর্ন বাংলা না জানা এই সচিব পদমর্যাদার অর্থনীতিবিদ বাংলাকে লাগাতার আক্রমণ করে যাচ্ছেন। বড় বড় বাকতেল্লা মেরে যাচ্ছেন বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে।
গত ২০০ বছর ধরে গোটা ভারতবর্ষের শিক্ষা,সংস্কৃতি,সাহিত্য, শিল্প, সমাজসংস্কার, আধুনিকতা,কিংবা রাজনীতির পীঠস্থান কলকাতা। যেখানে ভারতের ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত ও সমাজতাত্ত্বিকরা বাংলার রেনেসাঁকেই আধুনিক ভারতের নবজাগরণের এপিসেন্টার বলে মনে করে,বিশ্বাস করে,সেখানে সঞ্জীবের থিওরি পৃথক,বরং আরএসএস এর ফর্মুলায় সমৃদ্ধ। রাজা রামমোহন রায় থেকে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্র নজরুল, চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র থেকে জগদীশচন্দ্র,প্রফুল্লচন্দ্র হয়ে সত্যজিৎ,ঋত্বিক ,মৃণাল হয়ে প্রবাহমান, সেখানে এই আধা বাঙালি সঞ্জীব বাঙালির মধ্যে প্রবাহমানতা খুঁজে পাচ্ছেন না। বাংলার সংস্কৃতি এবং উদার মানসিকতা নিয়ে যেমন আরএসএস আর ভাজপার সমস্যা আছে,ঠিক তেমনি ওনারও আছে। এখানে রাখি বন্ধনে আজও জাত দেখা হয় না। ঈদের পায়েস আসে হিন্দু বাড়িতে। দুর্গাপুজোর ভোগ যায় মুসলমান মহল্লায়। সরস্বতী পূজায় স্কুলের একই বেঁচে পাশাপাশি বসে খায় কোমল ,কামালরা। বড়দিনের কেক আসে হিন্দু মধ্যবিত্তের বাড়িতে। এখানে গোধরা অত্যাচারিতরা নিরাপদ আশ্রয় পায়। এখানে ভ্যালেন্টাইন ডেতে জয় শ্রীরাম বলে ভাঙচুর হয় না।
হ্যা এখানে এখনও জাতের নামে বজ্জাতি নেই। তাই বাংলা এবং বাঙালি আজও স্বতন্ত্র,আজও মৌলিক। আধা বাঙালি সঞ্জীববাবু সেটা জানেন, ভাজপা আরআরএসও জানে। তাই ভয় পান। কুঁকড়ে যান বাঙালির সংস্কৃতি উদারতা দেখে। আধুনিকতার সাহস দেখে। ওনারা জানেন, গুজরাত কোনও শিল্পীর জন্ম দেয়নি, দেয়নি সাহিত্যের জন্ম। বিজ্ঞান,চলচ্চিত্র,শিক্ষা,উদারতার কোনও উধাহরন নেই,তাই তারা শঙ্কিত,আতঙ্কিত। বাংলা বিদ্বেষের জন্ম আজ থেকে নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই। বাংলা গোটা দেশের রাজনীতিকে সঞ্চালনা করত। গোটা দেশের রাজনীতি, আন্দোলন যদি স্বাধীনতা বিপ্লবের শরীর হয়,বাংলা ছিল মস্তিষ্ক ,সেটা ওরা জানেন। ডিভাইড অ্যান্ড রুল করে ব্রিটিশরাও কিছু করতে পারেনি,ওরাও পারবেন না।