৩৬৫ দিন। নন্দীগ্রাম। তমলুক। মহিষাদল। মেদিনীপুর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এখনো জ্বলজ্বল করে লেখা রয়েছে এই নামগুলি। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বারে বারে গর্জে উঠেছে অবিভক্ত মেদিনীপুর। মাতঙ্গিনী হাজরা থেকে শুরু করে অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের বুকের রক্তে বারে বারে ভিজেছে মেদিনীপুরের মাটি।
লবণ সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে অহিংস আন্দোলনে গোটা দেশের মধ্যে মেদিনীপুর যে অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তার জন্য ছুটে এসেছিলেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী নিজে।
এবারে সেই মেদিনীপুরে সেই তমলুকে সেই মহিষাদলে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী উগ্র হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো নাথুরাম গডসের মাহাত্ম্য প্রচারে মাঠে নেমে পড়েছেন ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা তথা কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত বিচারপতি হিসেবে নিজের নাম লিখে যাওয়া প্রাক্তন বিচারপতি তথা ভাজপা প্রার্থী অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায়।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে নেমে যেমন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক গুরু শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রাম তথা মেদিনীপুরের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে পাকিস্তানি বলে ভারত থেকে বিতরণের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এবারে শুভেন্দুর হাত ধরে সেই তমলুকে এবং মহিষাদলে নাথুরাম গডসে কতখানি মহান ছিলেন তার প্রচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায়।
ভাজপার হাত ধরে সভ্যতার সংকট
ঠিক যেমন ভাবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করে ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দেওয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে বাংলার নবজাগরণের রূপকার বলে বাংলা এবং বাঙালির সভ্যতাকে বিকৃত করার খেলায় নেমেছেন খোদ বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার তথা জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার কারিগর নাথুরাম গডসেকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলে প্রচার করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন অভিজিৎ গাঙ্গুলী। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভাজপার হাত ধরে তৈরি হচ্ছে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সংকট। মানব সভ্যতার সংকট। বেইমান বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীদের মহান সাজিয়ে দেশের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে নতুন ইতিহাস লেখার খেলায় নেমেছে ভাজপা।
গডসে ভক্ত অভিজিৎ
মহাত্মা গান্ধীর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মাথায় রেখে ১৯৪৭ সালে ভারত বর্ষ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তাকে জাতির জনক উপাধিতে ভূষিত করার পরেও ১৯৪৮ সালে নাথুরাম গডসে গুলি করে হত্যা করেছিল গান্ধীজিকে। আজ পর্যন্ত যেখানে নাথুরাম গডসের বংশধর এরা পর্যন্ত নিজেদের পূর্বপুরুষের নাম নিজেদের নামের সঙ্গে জুড়তে লজ্জায় মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে সেখানে বিচার ব্যবস্থাকে কলংকিত করে আসা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত নাথুরাম গডসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচার করে চলেছেন গান্ধীজিকে হত্যার জন্যে নাকি নাথুরাম গডসের অসংখ্য যুক্তি ছিল। তাই ভোট প্রচারের মাঝেই তিনি নাথুরাম গডসের লেখা এবং নাথুরাম গডসেকে নিয়ে লেখা বইপত্র পড়াশোনায় মন দিয়েছেন।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করার পরে ভাজপা নেতা অভিজিৎকে প্রশ্ন করা হয় গান্ধী না গডসে? তার উত্তরে তিনি বলেন, গান্ধী একজন নিহত মানুষ আর গডসে একজন হত্যাকারী। তবে একজন আইনজীবী হিসেবে আমাকে ভাবতে হবে গান্ধীকে হত্যা করার পিছনে গডসের কী যুক্তি ছিল। তা জানা প্রয়োজন রয়েছে।
বিচারপতির চেয়ারে বসে থাকাকালীন যিনি কখনো অভিযুক্তদের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন বোধ না করেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের মতো একের পর এক রায় ঘোষণা করে গিয়েছেন সাংবিধানিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে তিনি নাকি আজ ৭৫ বছর পরে নির্দোষ থাকার প্রমাণ খুঁজে চলেছেন। এ কথা নিজেই স্বীকার করে অভিজিৎ গাঙ্গুলির বক্তব্য, আমি শুনেছি গান্ধীকে হত্যার পিছনে গডসের নাকি ৭৫ থেকে ৮০ যুক্তি ছিল। তিনি একটি বই লিখেছিলেন। বাংলায় তার অনুবাদও হয়েছিল যদিও সেটি পরে ব্যান করে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি জানান, গডসের লেখা সেই বই পড়ে তিনি জানতে চান যে কোন ধারনায় অনুপ্রাণিত হয়ে গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন গডসে। তিনি বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি তাঁর বক্তব্য জানতে না পারছি ততক্ষণ আমি গান্ধী না গডসে এদের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে পারবো না।
ড্যামেজ কন্ট্রোলে অভিজিৎ
তবে বারে বারে নাথুরাম গডসে কে যেভাবে মহান করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন অভিজিত গাঙ্গুলী এবং নিজেকে হিন্দুত্ববাদী বলে স্বীকার করে নিয়েছেন প্রকাশ্যে, তারপরে নন্দীগ্রামসহ মেদিনীপুর তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মুসলিম ভোটারদের মন পাওয়া মুশকিল হবে বুঝতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে রাতারাতি মহাত্মা গান্ধীর মূর্তিতে মালা দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের দরগায় প্রণামের নাটক করতেও পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। ভোল বদল করে এখন অভিজিতের বক্তব্য ভাজপা তো গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে চায়। যা শোনার পরে পাশে থাকা শুভেন্দু অনুগামীরাও হাসি চেপে রাখতে পারেননি!