অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মৃৎ শিল্পী, ডাকি সকলে ফেসবুকে প্রচারে আতঙ্কিত
৩৬৫ দিন। আমার ঠাকুমার বাড়িটা ছিল শোভাবাজারের গঙ্গার ধারে। ছোটবেলায় পুজোর কয়েক মাস আগে, ঠাকুরমার বাড়ি ঘুরতে গেলে ফেরার পথে বাবা নিয়ে যেতেন কুমারটুলিতে ঠাকুর বানানো দেখাতে। কুমারটুলিতে গেলেই মনটা আনন্দে ভরে যেত। যখন দেখতাম কাঠের কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে মা দুর্গা তৈরি হচ্ছে,কি যে আনন্দ হত। মনে হত,আর মাত্র কয়েকটা দিন,তার পরেই পুজো। তবে, পূজোর আগেই বৃষ্টিতে নাজেহাল হতে হত মৃৎশিল্পীদের। নিজের চোখে দেখা, কি কষ্ট করেই না মৃৎশিল্পীদের কাজ করতে হত। বৃষ্টিতে মাটি গলে যেত। অপেক্ষা করত হতো কখনো একটু সূর্য উঠবে, মাটি জমবে, তাহলে মূতিটা তৈরি শেষ হবে। অন্যদিকে, বাড়ির ভেতরে শোলার কাজ চলত। একদিকে দুর্গার শাড়ি তৈরি কাজ চলতো। দেখতাম শিল্পীরা সেই জমকালো শাড়ির ওপর বিভিন্ন ধরনের চুমকি লাগত, সেটাও আমার দেখা। সেই সময় শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই চেনা ছিল আমার বাবার। তিনি ওদের সঙ্গে গল্প করতো, আমি পাশে দাঁড়িয়ে শুনতাম তারা বলছেন, বৃষ্টিতে কাজ করতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে সঠিক সময়ে মূর্তি তৈরি করে উঠতে পারবো কিনা জানি না। এমনকি তাদের আমি কাঁদতেও দেখেছি। আবার কদিন বৃষ্টি বন্ধ থাকলে, জোরকদমে চলতো প্রতিমা বানানোর কাজ। দিনরাত এক করে খাওয়া ভুলে গিয়ে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন শিল্পীরা। তাদের পরিবার, বাচ্চারা, স্ত্রী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, যাতে তাড়াতাড়ি দুর্গা প্রতিমা সময়মত তৈরি হতে পারে। প্রতিমা বউনি না হলে টাকা আসবে না। সংসার চলবে না, পরিবারকে খাওয়াবে কি? সন্তানদে জামা কাপড় কিনে দেবে কি করে। তখন বাবা বলতেন, ওদের সারা বছরের উপার্জন এই সময়তেই হয়। এমনও দেখেছি, মহালয়ার ঠিক পরেই একবার প্রবল প্রবল বৃষ্টিতে জল জমে গেল, উত্তর কলকাতায়। কি দুর্বিষহ জীবন। ত্রিপল খাটিয়ে, চৌকির ওপর বা কোন কাঠের পাটাতনের উপরে প্রতিমা তুলে। সারা রাত গোটা পরিবার একত্রিত হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।সেই জমানায় লোডশেডিং ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রায় রাতেই বিদ্যুৎ চলে যেত। জল জমে থাকায় বিদ্যুৎ ছিল না প্রায় তিন চারদিন। দেখেছি মোমবাতি ধরে আছে শিল্পীর বউ ছেলে মেয়েরা, আর শিল্পী নাওয়া খাওয়া ভুলে দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে সারা রাত ব্যস্ত। এদিকে প্রতিমার বায়না হল না। প্রবল বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত, অসহায় সেই শিল্পীর পরিবার। পঞ্চমী অবধি প্রতিমার বউনি নেই। এদিকে প্লাস্টিক, ত্রিপল, কাঠামো, মূর্তি, রং সব কিছুর জন্য বিপুল ধার হয়েছে মহাজনের থেকে। বোধনের দিন খবর পেয়েছিলাম, সেই শিল্পীর মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। পরিবারের সামান্য হলেও বোঝা কমাতে গিয়ে মেয়েটি চলে গেল। যাকে দেখতাম বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিমাতে মাটির প্রলেপ দিতে,শাড়ি পড়াতে,টিপ আঁকতে,সেই মেয়েটি জাস্ট প্রতিমা বউনি না হওয়ায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হল। ঘটনার উল্লেখ করলাম এই কারণে, এই দুর্গোৎসব কত মানুষের জীবন, মরণ বাঁচন সেটা বোঝানোর জন্য। আমরা কেবল উৎসবমুখর চার কি পাঁচটা দিন নিয়ে ভাবি। কিন্তু একটা দুর্গা প্রতিমা বানানোর পিছনে মৃৎশিল্পী, হস্তশিল্পী সহ অসংখ্য মানুষ ও পরিবারের এই পরিশ্রম কষ্ট জানতে পারি না। আজ কুমারটুলির ছবিটা পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন প্রত্যেকটা শিল্পীরই ঢালাইয়ের ঘর। ওয়ার্কশপ যেখানে একটি দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয় এখন বৃষ্টি হলে কুমাতুলিতে আর জল দাঁড়ায় না। বিদ্যুৎ যায় না। এমনকি ঠাকুর বানাতেও এদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। পূজো বাড়ার সাথে সাথে এদের রোজগারটাও বেড়েছে জীবনযাত্রা সচ্ছল হয়েছে। আজ এই শিল্পী ও তাদের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপার্জন ও বেড়েছে। আজ যারা নির্যাতিতার আন্দোলন নিয়ে দুর্গোৎসব বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলছে, তারা আসলে এই শিল্পী ও পেশার সঙ্গে যুক্ত ৭০ হাজার পরিবারের ভাত কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। একটা দুর্গাপুজোয় গ্রাম থেকে ঢাকি, থেকে একডজন অনুসারী শিল্পী ও কয়েক লক্ষ কর্মী আসে রোজগারের তাগিদে। যারা পুজো বন্ধ করার কথা বলছেন তারা কি একবার এই মানুষদের কথা ভেবেছেন কি? যাদের এই পুজোর সময় দেখা যায়, তাদের এই রোজগার তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করে। তাদের আর তাদের পরিবারকে ভাতে মারতে চাইছেন। জাস্টিস পাওয়ার নাম করে এই নোংরা রাজনীতি করা আপনারা বন্ধ করুন। কারন আপনারা পূজোয় বিশ্বাসী নন তাই এবার আপনারা পূজো বন্ধ করার আন্দোলনে নেমেছে। বরং যারা বড় বড় কথা বলছেন হ্যাঁ আপনারা আপনাদের এক মাসে বেতন আর বোনাসটা বা সরকারি ডি এ না পেলেই রাস্তায় প্রতিবাদ করতে নেমে যান। এই গরীব মানুষগুলোর জন্য দান করে দিন তবে বুঝবো এই আন্দোলন সত্যি জাস্টিস পাওয়ার আন্দোলন।