অর্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৬৫ দিন। জানেন, রাজপথ কাকে বলে? কোনওদিন জেনেছেন ভাট, চোপড়া পরিবারের মেয়েরা। তাঁরাও বলে সোশাল ডিয়ায় আরজি কর নিয়ে ট্যুইট করছেন। বোঝো কাণ্ড! বলছেন কি নির্ভয়ার পর কলকাতার এই আরজি কর কান্ড। তাই নাকি?
মুম্বই শহরে কী হয়েছিল, আপনারা কি ভুলে গিয়েছেন। সমাস ইভের দিন রাতে রাস্তায় একটি মেয়েকে উলঙ্গ রেছিল। ঐ আপনাদের প্রিয় জুহু বিচে।
কটার পর একটা উত্তর প্রদেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যে। মার সৌভাগ্য আমি মহারাষ্ট্র, মুম্বই, লখনউ, উত্তর প্রদেশে আইনি। আমার সৌভাগ্য আমি কলকাতার বাঙালি মেয়ে হয়ে ন্মেছি। মার্সিডিজ বা বিএমডব্লুউ বা আরও কোনও বড় গাড়ি
থেকে নেমে কোনও পার্টি, রেস্তোরাঁ, কর্মস্থলে পৌঁছতে হয় না। আমার সৌভাগ্য, করিনা কাপুর, আলিয়া ভাট, প্রিয়াঙ্কা চোপরা ও পতৌদিদের মতো আপনাদের বংশের মেয়ে হয়ে জন্মাতে হইনি। এগুলো ছেড়ে একদিন মেয়ে হয়ে এসে দেখুক শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে অফিস টাইম বা রাতে লাস্ট ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরে মেয়েরা। এক্স হ্যান্ডেল বা সোশাল মিডিয়ায় দু’লাইন লিখে দিলেই প্রতিবাদ করা হয় না। আয়ুষ্মান খুরানা একটি কবিতাও লিখে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে ফেললেন। একটু কলকাতা শহরের রাতে না ঘুরে মেয়েদের জীবনযাত্রা না দেখে মন্তব্য করাটা এখনকার দিনে খুব সহজ। কবিতাটা না বলে একটু রাস্তায় নামুন না। রোজ রাতে আমাদের অফিসে
বহু মেয়েরাই লাস্ট ট্রেন বা পুরুষ অফিস কলিগদের সঙ্গে মাঝরাতে বাড়ি যায়।
আমি একজন ওয়ার্কিং রিপোর্টার, সংবাদপত্রের দায়িত্ব সামলে রাত ৩টেয় বাড়ির পথে রওনা দিই, সম্পূর্ণ একা। এই রুটিন আমার গত ১৪ বছরের। আমি প্রতিদিনই রাত জাগি। মোমবাতি হাতে আমায় মিছিলে পা মেলাতে হয়নি। সংবাদ সংগ্রহ, পরিবেশন এবং সামাজিক এই দায়িত্ব পালন করে আসছি মানুষের জন্য। কলকাতা পুলিশের রাতের টহলদাররা সবাই আমাকে চেনেন। তারা জানেন, আমি ৩৬৫ দিনই রাত জাগি। শুধু মোমবাতি হাতে, শঙ্খ বাজিয়ে, সেলফি তুলে,শুধু লাইকের আশায় হুজুগে আমি পথে নামিনি।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাত দখল আমার অ কাঙ্খিত লক্ষ্য নয়। আমি আরও লক্ষ কর্মরত মেয়ের মত প্রতিদিন রাজপথে নামি। জাতীয় রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের নিরাপদতম শহর কলকাতায় মাথা উচু করে বলি,এখ ানে প্রতি রাতই নারীদের। বলতে দ্বিধা নেই,তোমার মৃত্যু আমায় অপরাধী করে দেয়। নির্ভয়া থেকে হাথরস সারা দেশে এমন প্রতিটা মৃত্যুই আমায় শোকার্ত করে। গুজরাতে বিলকিস বানুর গনধর্ষণকারীরা যখন রাষ্ট্রের থেকে রাজকীয় সম্বর্ধনা পায়, তখ ন নারী হিসাবে লজ্জিত হই। উন্নাওতে একটি দলিত নারীকে যখন ধর্ষণ করে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, অনার কিলিংয়ের নামে যখন হরিয়ানায় কিশোরীকে পিটিয়ে মারা হয়, তীব্র ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। সম্ভাব্য সন্তান নারী বলে যখন ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মধ্যপ্রদেশে কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, আমি শিউরে উঠি। রাজস্থানে যখন রূপ কানোয়ারকে সতী হতে হয়, আমি নারী হিসাবে লজ্জায় মুখ ঢাকি। প্রতিটা মৃত্যুই আমার কাছে প্রতিবাদের। শুধু তোমার জন্য নয়, রাজপথে নামলে সবার জন্যই নামব।
প্রতিবাধ আমি শুধু তোমার জন্য করবো না প্রতিবাদ করলে সবার জন্য করব। প্রতিবাদ করব সেই ১৮ বছরের ছাত্রটির জন্য, যার অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মৃত্যু হল।
যাদবপুরের সেই ছাত্র ছাত্রীরা, আজ যারা মোমবাতি নিয়ে বিচার চাই বলছে, এক বছর আগেই তারা হত্যা করেছে একটা তরুণ প্রাণকে। উলঙ্গ করে যার ওপর অত্যাচার হয়েছে,দাদা দিদিদের বিনোদনের জন্য। আমার চোখে সেটাও ধর্ষণ। সেই হত্যাকারীরা আজ ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে। আর কিছু মিডিয়া, যারা আজ মুখোশ পড়ে মানুষকে হুজুগে উস্কাচ্ছে, সেদিন তারা ছিল বিস্ময়কর ভাবে চুপ। গ্রামের সেই বাবা মায়ের কোল শূন্য হয় নি? সেই মৃত্যুটা মৃত্যু নয়। কি লজ্জা! লজ্জা! আমি শুধু তোমার জন্য নয়, এদের সবার জন্য রাজপথে নামব। এ আমাদের শহর আজও নিরাপদ তাই রাতে মেয়েরা আজ রাজপথে একা যাতায়াত করতে পারে।
দুঃখিত নির্যাতিতা বোন, তোমার খুনের বিচার তুমি হয়তো পাবে না…
দুঃখিত নির্যাতিতা বোন, তোমার খুনকে ইস্যু করে কিছু রাজনৈতিক দল আর মানুষ তোমার সঠিক বিচার হতে দিল না। এ যারা প্রতিবাদ করছিল তারাই তোমার প্রমাণ লোপাট করে দিল। পুলিশকে তদন্ত করতে না দিয়ে তাদের রাজপথ পাহারা দিতে • নামিয়ে দিল… তোমার মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। কিন্তু রাজপথে এ নেমে পুলিশ তদন্তে বাধার সৃষ্টি করতে পারলাম না। সত্যি খ ■ব দুঃখজনক অভয়ার ওপর যে অত্যাচার যে ধর্ষণ যাই হয়ে ■ থাকুক না কেন সেটা খুবই নিন্দা জনক কিন্তু আমরা কেউই । জানিনা আসল সত্যিটা কি কি ঘটেছিল সেদিনকে রাতে কি ■ ঘটেছিল সেই কনফারেন্স রুমে কারা কারা ছিল কেন ছিল কোন কিছুই আমরা জানিনা, আগে তো আমরা সত্যিটা জানি প্রশাসনকে কাজ করতে না দিয়ে ব্যর্থ বলে চেঁচামেচি করি তাদের কাজে বাধা দিই তাহলে আসল সত্যিটা তো কোনদিনই ■ জানা যাবে না। আসুক না তদন্তে সম্পূর্ণ রিপোর্টটা আমাদের ■ সামনে আসুক তখন আমরা আন্দোলনে বসি। আমরা কিছু চ মিডিয়ার গল্পকথা শুনে প্রতিবাদ করতে নেমে পড়লাম। জানি না কত রাজনৈতিক রঙ এতে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
■ যারা আজ মুখ্যমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলছে, তারা লক্ষ্মীর ভান্ডার । নেয় না তো? সরি অভয়া, যারা প্রতিবাদ করেছিল বাচ্চাদের নিয়েও, তাদের আজ সেলফি তুলে প্রমাণ করতে হচ্ছে- আমরা। মিছিলে ছিলাম। সত্যিই যদি বিচার চাইতো, তাহলে কি সেলফি তুলে আপডেট দিতে পারতো? হা! হা! হা! আজ ডাক্তাররা – স্ট্রাইক করছে মিছিল করছে প্রতিবাদ হচ্ছে আর জি কর বিভিন্ন রাস্তায় মিটিং মিছিল বসছে। একজনের মৃত্যুর জাস্টিস চাইতে এ গিয়ে আরো কত মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে নেমে গেছি আমরা। যাদের চিকিৎসা না হয়ে মরে যাচ্ছে চিকিৎসা পাচ্ছে না হসপিটালে চারদিকে পরিবারের লোেকরা দৌড়ে বেরাচ্ছে কি করে কোন ডাক্তার এ হাত ধরে নিয়ে এসে তার রোগীকে একটু দেখবে বলে। তাদের কি জীবনের কোন দাম নেই নাকি। দুর দুর গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোর আপনার আমার মত সামর্থ্য নেই নার্সিংহোেম এ লক্ষ টাকা খরচ করে আপনজনের প্রাণ বাঁচানোর। মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া সাস্থ্য সাথী ভরসা করে কলকাতার হাসপাতালে আসে তারা। সেই রকম সন্তানসম্ভবা নারী যদি মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়,তার দায় নেবেন তো ডাক্তাররা? দরিদ্র বাবার একমাত্র সন্তানের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হলে তার বোঝা বইবেন যারা সেলফি তুলতে রাস্তায় নামলেন? তাদের জাস্টিস টা কে দেবে? আজ তোমার জন্য সারা দেশ নেমেছে, কাল আরেকটি মেয়ের মৃত্যুর জন্য সবাই আবার প্রতিবাদ দেখাবে তো? প্রতিবাদ করছেন সেই করা উচিত কিন্তু সব সময় সব দোষ সবার হয় না কিছুটা নিজেরও দোষ থাকে। হ্যাঁ আমি একজন নারী হয়েই বলছি। নিজের দোষ থাকলে তবেই একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আমি তখনই প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামবো। যখন আমি দশটা অত্যাচারীতো মেয়েদের বাঁচাতে পারবো। মহিলারা নারীরা প্রতিবাদ করুন রোজ করুন, যেখানে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মা বাবার কোলের মেয়েকে পুড়িয়ে মারছে বা স্বামী স্ত্রীকে খুন করছে বা স্বামী রোজ রাতে মেয়েটিকে পেটাচ্ছে, সেও তো বাবা-মার একটি মেয়ে তারও কি কষ্ট হয় না, না হয় না। যেসব মেয়েরা অত্যাচারিত হয় কিন্তু সমাজের ভয়ে মুখ খুলতে পারেনা, কারণ তাদের পাশে প্রতিবাদ করার মতন কোন নারীরা গিয়ে মিছিল করতে দাঁড়ায় না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে যখন একটি মেয়েকে রোজ রাতে তার বর বা অন্য কেউ জোরজবস্তি করছে। সেই মেয়েটার রোজ মৃত্যু হচ্ছে। তোমার মৃত্যুটা সেন্টিমেন্ট ইস্যু করে কিছু লোক রাজনৈতিক ফায়দা লুটে গেল। যারা দোষী তারা শাস্তি পাক সেটাই চাই। আর যদি না পায়, তাহলে যারা রাস্তায় নেমে তোমার মৃত্যুকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলল, তাদের তুমি বুঝে নিও।